জঙ্গি সংগঠন আরসাই হত্যা করেছে মুহিব উল্লাহকে
2022.06.14
ঢাকা ও কক্সবাজার

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করার কারণে জনপ্রিয় নেতা মুহিব উল্লাহকে মিয়ানমারের জঙ্গি সংগঠন আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আহম্মার প্রকাশ জুনুনী এর নির্দেশে হত্যা করা হয় বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকের আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন মুহিব উল্লাহ। তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এই হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সবাই কথিত আরসা/আল-ইয়াকিনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও কর্মী। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, মানবপাচার ও মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অপকর্মের জনশ্রুতি রয়েছে।
সোমবার মুহিব উল্লাহ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন কক্সবাজার আদালতে জমা দেয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম।
রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার উপস্থিতি রয়েছে- এমন কথা বিভিন্ন মহল থেকে বলা হলেও সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি স্বীকার করে না। এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আরসার উপস্থিতি স্বীকার করল সরকার।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমাদের যা বলার সেটি তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছি। তদন্তের বাইরে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই।”
আদালত এই প্রতিবেদন গ্রহণ করার পর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু করবে।
উল্লেখ্য, মুহিব উল্লাহর পরিবারের সদস্যরা গত মার্চের শেষ দিকে বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডায় আশ্রয় নিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন।
প্রতিবেদনে হত্যার বিবরণ
তদন্ত প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে। এতে মোট ২৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫ জন জেলে ও ১৪ আসামি পলাতক।
তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ জানিয়েছে, আরসা এবং আল-ইয়াকিন/আলেকিন একই জঙ্গি সংগঠন। ঘটনার দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে রোহিঙ্গা শিবিরে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস কার্যালয়ে ১০ থেকে ১২ রোহিঙ্গার সাথে আলোচনা করছিলেন মুহিব উল্লাহ। আরসা সদস্য আব্দুর রহিম প্রকাশ ওরফে রকিম মাস্টার নাম ধরে মুহিব উল্লাহকে ডেকে বলে তুই “ওঠ”।
মুহিব উল্লাহ বসা অবস্থা থেকে দাঁড়ানোর সময় আব্দুর রহিম “দেশীয় পিস্তল সাদৃশ্য অস্ত্র” দিয়ে মুহিব উল্লাহর ডান স্তনের উপরে একটি গুলি করেন।
এরপর একই ধরনের অস্ত্র দিয়ে জাহিদ হোসেন লালু মুহিব উল্লাহর ডান স্তনের একটু ওপরে পরপর দুটি ও খাইরুল আমিন ডান কাঁধে একটি গুলি করেন।
গুরুতর জখম হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মুহিব উল্লাহ।
ঘটনাস্থল থেকে পালানোর পথ করতে মোজাম্মেল হক প্রকাশ ওরফে লাল বদিয়া, ছমির উদ্দিন প্রকাশ নুর কামাল, আজিজুল হক, ফয়েজ উল্লাহ ফাঁকা গুলি করেন।
যাওয়ার আগে হত্যাকারীরা মুহিব উল্লাহর ভাই ও মামলার বাদী এবং উপস্থিত অন্যান্য রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি দেখায়।
আত্মীয়-স্বজন, মামলার সাক্ষী এবং অন্যান্যদের সহায়তায় কুতুপালং মেডিসিন স্যানস ফ্রন্টিয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার রাত নয়টায় মুহিব উল্লাহকে মৃত ঘোষণা করেন।
কেন মুহিব উল্লাহকে হত্যা?
প্রতিবেদনে অনুযায়ী, মুহিব উল্লাহ শিক্ষিত ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়ায় রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে আসা জাতিসংঘ প্রতিনিধি, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। ফলে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথেও সাক্ষাত করেন।
২০১৯ সালে রোহিঙ্গা বিতাড়নের দুই বছর উপলক্ষে রোহিঙ্গা শিবিরে আয়োজিত জনসমাবেশে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার সমাগম হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “প্রত্যাবাসন বিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠন কথিত আরসা প্রধান নেতা আতাউল্লাহ আবু আহম্মার প্রকাশ জুনুনী” মুহিব উল্লাহর নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেনি। মুহিব উল্লাহকে তাঁর প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ করতে বললেও তিনি সেটি শোনেননি।
মুহিব উল্লাহর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর জন্য আরসা/আল ইয়াকিনের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে আরসা/আল ইয়াকিনের প্রধান নেতা আতাউল্লাহ আবু আহম্মার জুনুনী ও তার অন্যান্য জঙ্গিরা ওস্তাদ খালেদ প্রকাশ খালিদ, ওস্তাদ হাশিমরা মেনে নিতে পারেনি।
আতাউল্লাহ আরসায় যোগ দিতে মুহিব উল্লাহকে আহ্বান জানালে তিনি সেটি প্রত্যাখ্যান করেন।
মুহিব উল্লাহকে হত্যার সময় পাহারার দায়িত্বে থাকা আটক আসামি আজিজুল হকের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ঘটনার পেছনের বর্ণনা রয়েছে।
আজিজুল হকের মতে, “মুহিব উল্লাহ আরসার নেতাদের চেয়ে বড়ো নেতা হয়ে যাচ্ছিল। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার কথিত সদস্যরা তাকে সহ্য করতে পারছিল না।”
পুলিশকে আজিজুল জানান, ঘটনার দুদিন আগে আনুমানিক রাত ১১টায় ফারুক মাঝির ব্লকে মারকাজ মসজিদে মাস্টার আব্দুর রহিম ও অন্যান্যরা একটি গোপন বৈঠক করেন। সেখানে আজিজুল হকও ছিলেন এবং পাহারা দিচ্ছিলেন।
ওই বৈঠকে হত্যাকারী আব্দুর রহিমকে উদ্ধৃত করে আজিজুল হক বলে, “আমরা বাইরে পাহারা দিচ্ছিলাম। তখন শুনি মাস্টার আব্দুর রহিম বলেন, আমাদের বড়ো নেতা আতাউল্লাহ আবু আহম্মার জুনুনী, ওস্তাদ খালেদ প্রকাশ খালিদ, ওস্তাদ হাশিম বলছে; ‘মুহিব উল্লাহ আমাদের চাইতে বড়ো নেতা হয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা তাকে বেশি সাপোর্ট দিচ্ছে। তাকে মেরে ফেলতে হবে। মানুষ যেন না জানে এমনভাবে মারতে হবে।”
‘শিবিরে আরসার উপস্থিতি আছে’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার উপস্থিতি আছে। সেটি মুহিব উল্লাহ হত্যার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। তবে রোহিঙ্গাদের বৃহত্তর অংশ আরসাকে সমর্থন করে না।”
তিনি বলেন, “আরসাকে সমর্থন না করার সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো, তাদের কারণেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রাখাইন থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। তাদের যা কার্যক্রম সেগুলো মূলত মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকারের পক্ষে যায়।”
আব্দুর রশীদ বলেন, “এই অবস্থায় সরকারের উচিত, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তাদের দমন করার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে একত্রে কাজ করে আরসাকে উৎখাত করে শরণার্থী শিবির নিরাপদ রাখা।”
আসামি কারা?
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী মোট ২৯ আসামির মধ্যে ১৫ জন জেলে রয়েছেন। এরা হচ্ছেন; মোহাম্মদ ছলিম (৩৩), শওকত উল্লাহ (২৩), মোহাম্মদ সালাম (৩৯), জিয়াউর রহমান (৩৫), মোঃ ইলিয়াস (৩৪), মোঃ আজিজুল হক (২২), মোরশেদ ওরফে মুর্শিদ (২৪), নূর মোহাম্মদ (২০), আনাছ (১৯), নজিম উদ্দিন (৩৫), আবুল কালাম ওরফে আবু (৩৪), হামিদ হোসেন (৩০), সিরাজুল মোস্তফা প্রকাশ সিরাজউল্লাহ ওরফে প্রকাশ সিরাজ (৪৪), ইস্টের মৌলভী মোঃ জকোরিয়া (৫৩), খায়রুল আমিন (৩৮)।
এ ছাড়া অভিযুক্ত পলাতক ১৪ আসামি হলেন; মাস্টার আব্দুর রহিম প্রকাশ ওরফে রকিম (৩৫), জাহিদ হোসেন প্রকাশ লালু (৩৫) ও তার ভাই ফয়েজ উল্লাহ (২৮), ছমির উদ্দিন প্রকাশ ছমি উদ্দিন প্রকাশ নুর কামাল (৪০), সালেহ আহমদ (৩০), মোজাম্মেল প্রকাশ লাল বদিয়া (২৫), তোফাইল (২৮), মাস্টার শফি আলম (৪০), আব্দুস সালাম প্রকাশ জাকের মুরব্বি (৫৫), জকির (২৬), হাফেজ আয়াস (২৮), মাস্টার কাশিম (৩২), মাস্টার শুক্কুর আলম (৩৩) ও মোস্তফা কামাল (৩০)।
এ ছাড়া আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আহম্মার প্রকাশ জুনুনী, ওস্তাদ খালেদ প্রকাশ খালিদ, ওস্তাদ হাসিম, ইব্রাহিম, ইব্রাহিম, আলমগীর, শুভ প্রকাশ আলমগীর এবং মৌলভী মোস্তাকের ঠিকানা না পাওয়ায় তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
তবে ভবিষ্যতে ঠিকানা পাওয়া গেলে অথবা কেউ আটক হলে তাদের বিচার করা হবে।
কক্সবাজার থেকে প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সুনীল বড়ুয়া।