রাখাইনে যুদ্ধ, বাংলাদেশে অস্থিরতা, ব্যাপক হারে ঘটছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ
2024.09.13
কক্সবাজার ও ঢাকা
মিয়ানমারের আরাকানে সরকারি বাহিনীর সাথে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অব্যাহত লড়াই আর বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় সীমান্ত নিরাপত্তা নাজুক থাকায় গত কয়েক মাসে কয়েক হাজার নতুন রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অনুপ্রবেশ করেছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত সপ্তায় রাখাইনের মংডুর নয়াপাড়া গ্রাম থেকে প্রাণে বাঁচতে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন মো. ফিরোজ কামাল। তিনি বেনারকে বলেন, “রাখাইনে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি যাচ্ছে।”
“সেখানে থাকার অবস্থা নেই। খাবার নেই, থাকার ঘর, নেই অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা। প্রতিদিন জান্তা সরকার আরকান আর্মির যুদ্ধে মারা যাচ্ছে রোহিঙ্গা শিশু, নারীসহ বহু মানুষ।”
আরাকান থেকে পালানোর জন্য সীমান্তে জড়ো হওয়া লোকজনের ওপর “ড্রোন হামলা হচ্ছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “শতশত মানুষ মারা যাচ্ছে। আসার পথে অনেকের মৃতদেহ দেখেছি।”
রাখাইনের পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় “গত তিন মাসে অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে,” বলে বেনারকে জানান আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যানিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়ের।
তবে সরকারি হিসেবে অনুপ্রবেশের এই সংখ্যা কয়েক হাজার কম।
এ প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আমাদের প্রাথমিক মূল্যায়ন অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য এই রোহিঙ্গারা দেশব্যাপী সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় “দুর্বল আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে সুবিধা হিসাবে” ব্যবহার করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
চলতি মাসের শুরুতে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন জানান, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মিয়ানমারে জান্তা সরকারের রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সশস্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের কারণে সহিংসতা বেড়েছে, বিশেষ করে বাংলাদেশর সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে।
নিরাপত্তা সংকটের আশঙ্কা
সম্প্রতি প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের বড়ো একটি অংশ শরণার্থী শিবিরের বাইরে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন বলে বেনারকে জানান মোহাম্মদ জুবায়ের।
রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবিরের বাইরে অবস্থান নিরাপত্তা সংকট তৈরি করতে পারে এমন আশঙ্কায় ইতোমধ্যে সীমান্ত নিরাপত্তা শক্তিশালী করার জন্য অস্থায়ীভাবে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের আহ্বান জানিয়েছে কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফের পৌরশহরসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করেছেন বেনারনিউজের একজন প্রতিনিধি।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, গত কয়েক সপ্তাহে প্রতিটি এলাকায় রোহিঙ্গারা বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন এবং প্রতিদিন আরও অনেক রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ আদনান চৌধুরী বেনারকে বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় টেকনাফ সীমান্তে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর দুটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে।
“বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড সীমান্তে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কাজ করছে। তবে মধ্যরাতে সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে কিছু রোহিঙ্গা। তাদের মধ্যে অনেকেই শহরে বা গ্রামে গিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে,” যোগ করেন আদনান।
স্থানীয় প্রশাসন ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ধরন আর এবারের ধরন এক নয়। আগে রোহিঙ্গারা আশ্রয়হীন অবস্থায় পৌঁছে শরণার্থী শিবিরে পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নিতেন। তবে এবার পালিয়ে আসা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শহর ও গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন।
এবার যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন তাদের বেশিরভাগই রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের ব্যবসায়ী ও ধনী পরিবারের বলে জানান তাঁরা।
আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা বলছেন, নাফনদ-সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের টহল থাকলেও উপকূলের পঞ্চাশ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ অরক্ষিত।
এ বিষয়ে বিজিবির টেকনাফের ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “সীমান্তে দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে আমরা দালালদের তালিকা তৈরি করে তাদের ধরছি। ইতোমধ্যে আমরা কিছু রোহিঙ্গাসহ দশজন বাংলাদেশি দালালকে গ্রেপ্তার করেছি।”
তিনি বলেন, “আমরা নাফ নদীতে টহল কড়াকড়ি করেছি। পাশাপাশি উপকূল এলাকায়ও আমরা টহল জোরদার করব।”
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, গত আগস্ট মাসে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী সাড়ে চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে আটকের পর ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এদিকে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় রোহিঙ্গারা ভাড়া বাসায় থাকছেন বিষয়টি উপজেলার আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সভায় একাধিকবার অবহিত করার পরেও “কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি,” বলে বেনারকে জানান টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান।
বাড়ি ভাড়া করে থাকছেন রোহিঙ্গারা
ফিরোজ কামাল নিজের পরিবার নিয়ে টেকনাফের গোদারবিলে একটি ভাড়া বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। টিনশেড ছয় কক্ষের ওই বাসায় আরো দুই রোহিঙ্গা পরিবার ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকছেন তার আগ থেকে।
রাখাইন থেকে নৌকায় নাফনদী পেরিয়ে টেকনাফের বরইতলী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁর পরিবারের সাথে আরোর ১৪ জন রোহিঙ্গা ছিল।
বাংলাদেশে প্রবেশ করানোর জন্য “স্থানীয় দালাল ৫০ হাজার টাকা নিয়েছে” বলে জানান তিনি।
“ক্যাম্পে থাকার জায়গা না পেয়ে এখানে ভাড়া বাসায় উঠেছি। মাসে চার হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিতে হচ্ছে,” বলেন ফিরোজ কামাল।
নুর শাহেদ নামে আরেক রোহিঙ্গা টেকনাফের শিলবনিয়া পাড়ার এক প্রবাসীর ফ্ল্যাট বাড়িতে বাড়িতে উঠেছেন পরিবার নিয়ে।
রাখাইনের সুদা পাড়া গ্রামে জান্তা-আরকান আর্মিদের মধ্য ব্যাপক যুদ্ধ চলার প্রেক্ষিতে পালিয়ে এসেছেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে যাওয়ার জন্য ভাবছি। আগের মতো ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ হচ্ছে না। তাই আমার মতো অনেকে এখানে গ্রামে- গ্রামগঞ্জে এবং ভাড়া বাসায় আশ্রয় নিয়েছি।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন করে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি বড়ো অংশ আশ্রয় নিয়েছেন টেকনাফে স্থানীয়দের ভাড়া বাসায়। অধিকাংশ গ্রামের ভাড়া বাসায়ও রোহিঙ্গা ভাড়াটিয়া পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে টেকনাফের এক ভাড়া বাসার মালিক প্রবাসী মো. ইয়াছিন বেনারকে বলেন, “বিদেশে বসবাস করার কারণে এলাকার অনেক লোক অপরিচিত আমার কাছে। তাই কিছুদিন আগে দুটি পরিবার আমার ভাড়া বাসায় উঠেছিল। কিন্তু তারা যে রোহিঙ্গা ছিল সেটি আমার জানা ছিল না। ফলে প্রশাসন এসে তাদের (রোহিঙ্গাদের) ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আমি আর কোন রোহিঙ্গা পরিবারকে বাসা ভাড়া দেইনি।”
রাখাইন থেকে যারা পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছেন তাঁরা জীবন বাঁচানোর তাগিদে এখানে আসছেন। তাই তাদেরকে কোনো অবস্থাতেই “অপরাধীর মতো বিবেচনা না করে” তাদের নিরাপত্তা এবং ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সি আর আবরার।
শরণার্থীদের শিবিরের বাইরে থাকা তাঁদের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁরা শিবিরের বাইরে থাকলে “নানা ধরনের নিগ্রহ ও নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই তাদেরকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বুঝিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে প্রাথমিক কাজ।"