রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্ষমতাসীন দলের নেতা নিহত
2019.08.23
কক্সবাজার ও ঢাকা
কক্সবাজারে অস্ত্রধারীদের গুলিতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা মোহাম্মদ ওমর ফারুক (৩০) নিহত হয়েছেন।
এই অস্ত্রধারীদের রোহিঙ্গা বলে দাবি করেছে নিহতের পরিবার।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে আওয়ামী লীগের যুব সংগঠন যুবলীগের এই নেতাকে অস্ত্রধারী রোহিঙ্গারা টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে গিয়ে মাথায় গুলি করে হত্যা করে বলে পরিবারের অভিযোগ।
“২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার থেকে আসা মানুষের ঢল নামার পরে মানবিক দিক বিবেচনা করে নিজেদের ১৪ একর জমিতে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। এরপরও তাদের হাতেই আমার ছেলেকে মরতে হলো,” শুক্রবার বেনারকে বলেন নিহতের পিতা আবদুল মোনাফ কোম্পানি।
নেপথ্যে স্থানীয় রাজনীতি
আবদুল মোনাফের দাবি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই রোহিঙ্গাদের দিয়ে তাঁর ছেলেকে হত্যা করিয়েছে।
তিনি জানান, হ্নীলা ইউনিয়নের নয় নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ওমর ইউপি নির্বাচনে মেম্বর পদে অংশগ্রহণের কথা ভাবছিলেন।
“গত ঈদে এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ‘পোস্টার’ লাগিয়েছিল সে। তখন থেকে প্রতিপক্ষরা তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র করছিল,” বলেন মোনাফ।
উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আলমও বেনারকে বলেন, “এ ঘটনার নেপথ্যে যে স্থানীয় রাজনীতি রয়েছে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
পুলিশ কী বলছে?
তবে কি কারণে ওমরকে হত্যা করা হয়েছে তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস বেনারকে বলেন, “স্থানীয়রা বলছেন রোহিঙ্গা ডাকাত মোহাম্মদ সেলিম ও নুর মোহাম্মদ তুলে নিয়ে গিয়ে ওমরকে গুলি করে হত্যা করেছে।”
এই দুই ডাকাতের বিরুদ্ধে তাঁর থানায় পাঁচ-ছয়টি মামলা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”
তবে নিহতের বাবা বলেন, “ওমর বহুবার এই ডাকাতদের মুখোমুখি হয়েছে। ইচ্ছে থাকলে তারা তাঁকে আরো আগেই মারতে পারতো। যারা এই হত্যার নির্দেশদাতা, তাদেরও গ্রেপ্তার করতে হবে।”
হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গা শরণার্থী মোহাম্মদ ইউসুফ বেনারকে জানান, প্রথমে কয়েকটি ফাঁকা গুলি করে ওমরকে তুলে নেওয়া হয়। ঘটনার সময় ২০-৩০ জন সন্ত্রাসী ছিলেন। যাদের মধ্যে কয়েকজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলেও জানান তিনি।
হত্যার পরে ওমরের পরিবারকে তাঁর লাশ আনতে বাঁধা দেয় রোহিঙ্গা ডাকাতরা। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়লে তারা পালিয়ে যায়। পরে নিহত ব্যাক্তির লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়।
শরণার্থী শিবিরে স্থানীয়দের বিক্ষোভ
ঘটনার জেরে শুক্রবার সকাল আটটা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে বিক্ষোভ ও ভাংচুর করেছে স্থানীয়রা। তারা টায়ার জ্বালিয়ে জাদিমুরার প্রধান সড়ক অবরোধ করে। কয়েক দফায় লাঠিসোঁটা নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি ও একটি দোকানে ভাংচুর চালায়।
সেইভ দ্য চিলড্রেনের একটি কার্যালয়সহ আরো বেশ কিছু এনজিও’র সাইনবোর্ডও ভেঙে ফেলে তারা।
এ সময় বিক্ষোভকারী মোহাম্মদ ওসমান বেনারকে বলেন, “সবসময় রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে ওমর। তাঁদের পক্ষে কাজ করেছে। তাঁকে এভাবে হত্যার ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।”
পুলিশ এবং বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে পুরো এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
বিক্ষোভকারীদের পাশাপাশি নিহতের পরিবারের সদস্য এবং রাজনৈতিক সহকর্মীরাও এ ঘটনা দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
আতঙ্কে সাধারণ রোহিঙ্গারা
সরেজমিনে জাদিমুরা শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে সেখানে বসবাসকারী সাধারণ রোহিঙ্গাদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ দেখতে পেয়েছেন বেনার প্রতিনিধি।
শরণার্থী নুর আলম বেনারকে জানান, শুক্রবার সকালে স্থানীয়দের বিক্ষোভ, অবরোধ ও ভাংচুর শুরুর পর অনেক সময় রোহিঙ্গা আতঙ্কে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে।
নিহত ওমর রোহিঙ্গা-বান্ধব ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “সব সময়ই তিনি রোহিঙ্গাদের উপকার করতেন। তিনি রোহিঙ্গাদের হাতে খুন হওয়ায় ক্যাম্পের সবাই খু্ব বিব্রত।”
এর আগে বৃহস্পতিবার ভোরেই টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকার উলুবনিয়া সংলগ্ন নাফনদীর তীরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গুলিতে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের মোহাম্মদ সাকের (২২) ও টেকনাফের মৌচনি শিবিরের মো. নুরুল আলম (৩০)।
বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর শরীফুল ইসলাম জোমাদ্দার বেনারকে বলেন, “তারা দুজনই চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী।”
কঠোর হবে বাংলাদেশ
এদিকে শুক্রবার সকালে ঢাকায় আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপকমিটির এক আলোচনা শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, “আমাদের অবস্থানে আমরা একটু শক্ত হবো। আন্তর্জাতিক যেসব সংস্থা আছে আমরা তাদের বলছি, আপনারা আমাদের এখানে থেকে কোনো লাভ নেই, রাখাইনে যান।”
জাতিসংঘ কোনোভাবেই এই সমস্যা মেটানোর দায় এড়াতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা মিয়ানমারকে আবারও বলবো, তোমরা বারবার বলেছ, প্রতিশ্রুতি দিয়েছ। এখন তোমরা তোমাদের লোক নিয়ে যাও। যা যা করলে তারা যাবে, তা করো।”
শঙ্কিত অপরাধ বিজ্ঞানীরা
“রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হতে পারে, এমনটা আমরা (অপরাধ বিজ্ঞানীরা) অনেক আগেই আশঙ্কা করেছিলাম,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহরিয়া আফরিন।
“এটা নিয়ে আমরা গবেষণা করেছি, গত বছর একটা বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলনও হয়েছে আমাদের বিভাগের উদ্যোগে। সর্বত্রই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল এ নিয়ে,” যোগ করে তিনি বলেন “ বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর সময় সহিসংতার কাজে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হতে পারে, এমন শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।”
তাঁর মতে, “প্রতিঘাতমূলক রাজনীতির বদলে সুস্থ রাজনীতিচর্চা শুরু না হলে এগুলো দিন দিন বাড়তেই থাকবে। প্রতিটি দলের তৃণমূলের নেতাদের সতর্ক করে দেওয়া উচিত। যাতে তারা অসৎভাবে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার না করে।”
শাহরিয়া আফরিন বলেন, “রোহিঙ্গাদের ছাড়াও এই অপরাধটি করানো যেত। হয়ত এক্ষেত্রে তারা খুব কম চেষ্টায় বা পারিশ্রমিকেই রাজি হয়ে গেছে। কিংবা তাদের অন্যান্য কোনো সুবিধার লোভ দেখিয়েও জড়ানো হতে পারে।”