তিন সাঁওতালের হাতকড়া খুলে দেওয়ার নির্দেশ, নির্যাতিতদের ত্রাণ প্রত্যাখান
2016.11.14
গাইবান্ধায় নির্যাতনের শিকার সাঁওতালেরা সরকারি ত্রাণ প্রত্যাখান করে বলেছেন, তাঁরা আগে পৈতৃক জমি ফেরত চান। অন্যদিকে চিকিৎসাধীন তিন সাঁওতালের হাতকড়া খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ৬ নভেম্বর জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক–কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজন সাঁওতাল নিহত হন। পুলিশসহ উভয় পক্ষে আহত হন অন্তত ২০ জন।
এ ঘটনায় পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে গোবিন্দগঞ্জ থানায় ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং তিন থেকে চারশজনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে মামলা করা হয়। সোমবার বিকেল পর্যন্ত চারজন সাঁওতালকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, যাঁদের তিনজন চিকিৎসাধীন ছিলেন হাতকড়া পরা অবস্থায়।
হাতকড়া খোলার নির্দেশ হাইকোর্টের
চিকিৎসাধীন তিন সাঁওতালের হাতকড়া গতকাল সোমবার খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ও গাইবান্ধা পুলিশ সুপারের প্রতি ওই নির্দেশ দেওয়া হয়। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে রুল জারি করেন।
পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ চরণ সরেন, বিমল কিসকু ও দ্বিজেন টুডু এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁদের হাতকড়া পরা অবস্থায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে মর্মে একটি ছবিসহ খবর ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে ছাপা হয়। ওই প্রতিবেদন যুক্ত করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে সোমবার রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোর্তিময় বড়ুয়া। আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “আহতরা গুলিতে আহত হওয়ায় শারীরিকভাবে চলতে অক্ষম। তাঁদের পালানোর সম্ভাবনাও নেই। তাই তাদের এভাবে হাতকড়া পরানো মানবাধিকারের লঙ্ঘন।” এদিকে সাঁওতালদের ওপর হামলার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ–সমাবেশ হচ্ছে। হাইকোর্টের নির্দেশের পর গতকালই পুলিশ চিকিৎসাধীন সাঁওতালদের হাতকড়া খুলে দিয়েছে।
সহায়তা নেবেন না সাঁওতালেরা
গতকাল সোমবার সকালে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল হান্নান গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাপমারা ইউনিয়নের মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামে যান। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেড়শ পরিবারের প্রতিটিকে ২০ কেজি চাল, এক লিটার তেল, এক কেজি ডাল, এক কেজি আলু, এক কেজি লবণ ও দুইটি কম্বল বিতরণের কথা ছিল। আব্দুল হান্নান পরে বেনারকে জানান, “আমি ঘরে ঘরে গিয়ে ত্রাণ নেওয়ার অনুরোধ করেছি। কেউ আসেনি। আমি সকাল থেকে মাদারপুর গির্জার সামনে ত্রাণ নিয়ে অপেক্ষা করে সন্ধ্যায় উপজেলায় ফিরে আসি।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমিন বাস্কে বেনারকে বলেন, “আমরা ত্রাণ চাই না। আমরা বাপ-দাদার জমি ফেরত চাই।” ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, “প্রশাসনের মুখে সবসময় দুইরকম কথা শুনছি আমরা। সাঁওতালরা নিহত হয়েছে। আমাদের বসতবাটিতে আগুন দেওয়া হয়েছে, লুটপাট করা হয়েছে। আবার উল্টো মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদেরই হয়রানি করা হচ্ছে।”
সাঁওতালদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিক্ষোভ। নভেম্বর ১৪, ২০১৬। নিউজরুম ফটো
চিনিকলের জমিতে ঘরবাড়ি থাকবে না
সরকার ১৯৫৪ সালের দিকে এক হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। তখনই এ সব জমির মালিকদের আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তবে শর্ত ছিল, চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ ছাড়া ওই জমিতে অন্য কোনো ফসল চাষের জন্য ইজারা দিতে পারবে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, চিনিকল কর্তৃপক্ষ অন্য ফসল চাষের জন্য জমি ইজারা দিয়েছে। প্রতিবাদ হিসেবে সাঁওতালেরা ওই জমিতে ঘরবাড়ি তুলেছেন। গত ৬ নভেম্বর প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাঁধে।
ঘটনার নয়দিন পর গতকাল সোমবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়া সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, “কিছু স্বার্থান্বেষী ভূমিদস্যু ওই ঘটনায় ইন্ধন দেয়। নিরীহ ও সহজ সরল প্রকৃতির সাঁওতালেরা পরিস্থিতির শিকার। তাঁদের প্রতি সরকার অত্যন্ত সহানুভূতিশীল।” সচিব জানান, সেখানে হতাহতদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। প্রয়োজনে ভূমিহীন সাঁওতালদের পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সরকারি মালিকানাধীন চিনি কলের জায়গা দখল করে কাউকে থাকতে দেওয়া হবে না। ঢাকায় আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে শিল্প সচিব বলেন, ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। ইন্ধনদাতাদের সম্পর্কে সংবাদকর্মীদের নিশ্চিত করতে তিনি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেন, হঠাৎ করে গত ১ জুলাই ‘ভূমি উদ্ধার কমিটি’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে সাঁওতালসহ এলাকার ও এলাকার বাইরের কিছু লোক এসে চিনিকলের জমিতে অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করতে শুরু করে।
সংবাদ সম্মেলনে সাঁওতালদের বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়ার বিষয়ে শিল্প সচিব বলেন, ঘটনার পেছনের ইন্ধনদাতারা আগুন দিয়েছে বলে তাঁদের ধারণা।
আতঙ্ক, খাদ্যাভাব
ঘটনার নয়দিন পরও সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। মাদারপুর গ্রামের জোবা টুডু (৫৫) বেনারকে বলেন, “আমার একছেলে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ে। ভয়ে কলেজে যেতে পারছে না। কখন কে আবার হামলা করে বসে।”
মেরি টুডুর নতুন বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরনো বাড়িতে লুটপাট হয়েছে। তাঁরা চরম খাদ্যাভাবে আছেন।
এদিকে প্রশাসন নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেও সাঁওতালরা স্বস্তি পাচ্ছেন না। তাঁরা শিশুদের স্কুল-কলেজে পাঠাচ্ছেন না। বড়রা হাট–বাজারে যাওয়া থেকে বিরত থাকছেন। এ অবস্থার মধ্যেও সোমবার তাঁরা সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন।