রহস্যজনকভাবে নীরব জামিনে মুক্ত সরকারের তিন সমালোচক
2016.12.26
তাঁরা তিনজন। দুজন সম্পাদক, একজন রাজনীতিবিদ। সরকারের সমালোচনায় তাঁরা ছিলেন খুবই সরব। তিনজন ভিন্ন ভিন্ন মামলায় জেলে গেছেন, সম্প্রতি তিনজনই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
কিন্তু কারাভোগের আগে তারা যতটা সরব ছিলেন, ঠিক ততটাই এখন নীরব। তাঁরা এখন গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে চান না। সাংবাদিকেরা ভিড় করলেও জামিন পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া দেননি কেউই।
এই তিন আলোচিত ব্যক্তি হলেন; দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও বিএনপি সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান, যায়যায়দিন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক ও লেখক শফিক রেহমান এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।
তাঁদের পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, কারাভোগের পর থেকে শারীরিক ও মানসিক কারণে বিপর্যস্ত হওয়ায় তারা এখন চুপচাপ আছেন। শারীরিক সুস্থতার পর তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন।
তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সবার মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে। এ কারণে গ্রেপ্তার, রিমান্ড এবং কারাভোগের পর বেরিয়ে এসে কেউ আর মুখ খুলছেন না, রহস্যজনকভাবে চুপ হয়ে যাচ্ছেন।
২১ মাস পর মান্না ছাড়া পেলেন
নিউইয়র্কে অবস্থানরত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা এবং অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্নার টেলিফোন আলাপের দুটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ হয়। এরপর গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রায় ২১ মাস কারাভোগের পর গত ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান।
রাষ্ট্রদ্রোহ ও সেনা বিদ্রোহে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। ডাকসুর সাবেক এই সহসভাপতি (ভিপি) একজন সরব রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন ইস্যুতে গণমাধ্যমে তার মতামত প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে।
মাহমুদুর রহমান মান্নার সহধর্মিণী মেহের নিগার বেনারকে বলেন, জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে মান্না হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গণমাধ্যমে বা রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলার মতো শারীরিক অবস্থা তাঁর নেই।
গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হাসপাতালে মান্নাকে দেখতে যান। মান্না একসময় আওয়ামী লীগেরই সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন, যিনি পরে দল থেকে বাদ পড়ে নাগরিক ঐক্য গড়ে তোলেন।
সরকার দলীয় একটি সূত্র জানায়, শারিরীক অসুস্থতার কারণে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে। সরকারি দলের কয়েকজন নেতা তাঁকে কারামুক্ত করতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। এর ফলে মান্না সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর সমালোচনার জায়গা থেকে সরে গেছেন।
আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান
২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গ্রেপ্তার হন আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। বিরোধী দল বিএনপিপন্থী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তি গত ২৩ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পান। মাহমুদুর রহমান তার পত্রিকায় সরকারের কঠোর সমালোচনা করতেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।
কারাগার থেকে বের হয়ে আসার পর প্রায় এক মাস পার হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে মাহমুদুর রহমান গণমাধ্যমে কোনও কথা বলেননি।
মাহমুদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের মহাসচিব এম আব্দুল্লাহ বেনারকে বলেন, “তাঁকে কারাগারে নির্যাতন করা হয়েছে। মেরুদণ্ডে অপারেশনের জন্য তাঁর বিদেশে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু জামিনের শর্ত হিসেবে পাসপোর্ট রেখে দেওয়ায় তিনি যেতে পারছেন না।”
এম আব্দুল্লাহ বলেন, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় তিনি হাসপাতালেই কাটিয়েছেন। তবে তিনি দাবি করেন, কারাভোগের কারণে তার চিন্তা–ভাবনায় তেমন কোনও পরিবর্তন আসেনি।
প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমান
যায়যায়দিন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক ও প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্রের’ মামলায়।
প্রায় পাঁচ মাস পর গত ৬ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান। মুক্তির পর পরই কিছুদিন তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এরপর থেকে বাসায় প্রায় অন্তরীণ জীবনযাপন করছেন।
শফিক রেহমানের ব্যক্তিগত সহকারী সজীব ওনাসিস বেনারকে বলেন, কারাগারে প্রথম দিকে ডিভিশন ছাড়া রাখার কারণে শফিক রেহমানের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি প্রায় ১২ কেজি ওজন হারিয়েছেন। তার শারীরিক অবস্থা খুব নাজুক হওয়ায় বাসার বাইরে বের হন না বললেই চলে।
সরকার উদ্দেশ্যমূলক ও মিথ্যা মামলা দিয়েছে দাবি করে সজীব বলেন, এই বয়সে মামলার কারণে তিনি একটা ট্রমার মধ্যে রয়েছেন। তাঁকে নিয়মিত কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। সব মিলিয়ে তাঁকে খুব ক্লান্ত ও বিরক্ত মনে হয়। এ কারণেই গণমাধ্যমে বা কোনো অনুষ্ঠানে আগের মতো কথা বলেন না তিনি।
চুপ হওয়ার পেছনে কারণ আছে
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এই তিন ব্যক্তির চুপ হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। এভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ হওয়া কাম্য নয় বলে তাঁদের মত।
তবে সরকারের একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তাঁরা বেনারকে বলেন, তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান থাকায় আদালত অবমাননা এড়াতে এ বিষয়ে তাঁরা মন্তব্য করছেন না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, এই তিনজনের বেলায় দেখা গেছে যে, তাঁদের জামিন আবেদন বারবার প্রত্যাখান করা হয়েছে। কখনো দেখা গেছে আদালত সিদ্ধান্ত না দিয়ে বিব্রতবোধ করছেন। আবার তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে না।
নূর খান আরও বলেন, দেশে সম্পাদকদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। মানুষ নিখোঁজ হচ্ছে, কেউ ফিরে আসছে, কেউবা হারিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার জন্য খুবই জরুরি।