সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের অর্ধ শতাব্দি: দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা বেড়েছে বাংলাদেশের
2020.11.13
ঢাকা
বাংলাদেশের ইতিহাসে সত্তর সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়কে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভয়াবহ সেই ঘূর্ণিঝড়ের অর্ধ শতাব্দী পূর্তির সময়ে সরকার বলছে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওই ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা আর নেই।
৫০ বছর আগে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড়ে তছনছ হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) ভোলা দ্বীপ। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর তীব্র জলোচ্ছ্বাসে মারা যান কয়েক লাখ মানুষ। মাটির সাথে মিশে যায় বহু লোকালয়।
“স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল সেই ঘূর্ণিঝড়। মাটির বা টিনের যত বাড়িঘর ছিল তা ঝড়ে বিলীন হয়ে গিয়েছিল,” ১৯৭০ সালের সেই ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতিচারণ করে বেনারকে বলেন চট্টগ্রামের শহরের বাসিন্দা পুতুল দাশ গুপ্ত (৭১)।
“ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় লাশের পর লাশ পড়ে ছিল। ত্রাণ দূরে থাক, সেসব মরদেহ দাফন বা সৎকার করার লোক ছিল না,” বলেন তৎকালীন ডিগ্রি পড়ুয়া এই ছাত্র।
“তখন এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে কোনো পূর্ব সতর্কতা ছিল না,” বলে বেনারকে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন।
তিনি বলেন, “এখন অন্তত ১০ দিন আগে আমরা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাই। অত্যন্ত উন্নত স্যাটেলাইট ব্যবহার করায় ঝড়ের আগাম গতিবিধি আমরা বুঝতে পারি।”
এ বিষয়ে সরকার অত্যন্ত সংবেদনশীল উল্লেখ করে তিনি বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলায় এখন আমরা রোল মডেল। ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা কয়েক বছরে ৭ ডিজিট থেকে এক ডিজিটে আনা সম্ভব হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় বুলবুল, আম্ফান এবং ফণীতে প্রতিবেশী দেশের তুলনায় আমাদের দেশে মৃত্যুর হার খুব কম।”
দুর্যোগ মোকাবেলায় সারা দেশে বর্তমানে ৭৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেন জানিয়ে সচিব বলেন, “দেশে প্রচুর আশ্রয় কেন্দ্র করা হয়েছে। সিগন্যাল ৪-৫ নম্বরে এ চলে গেলেই লোকজনকে এসব আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়। জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে প্রচুর বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।”
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় ১৯৭০ সালের সক্ষমতার সাথে তুলনা করে তৃপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
“কত মানুষ মারা গেলো, তা দিয়ে দুর্যোগের মাত্রা ও ক্ষতি পরিমাপ করা ঠিক নয়। ঘূর্ণিঝড় আইলায় অনেক মানুষ মারা যায়নি। তবে বহু মানুষ এখনো ঘরবাড়ি ছাড়া, বাস্তুভিটা নেই। আইলার ১১ বছরেও সেই ক্ষতি এখনো পুষিয়ে ওঠা যায়নি,” বেনারকে বলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা।
তিনি বলেন, “আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ১৯৯১ সালের পর জোয়ার এবং সাইক্লোন একসঙ্গে হয়নি। এমনকি সিডরের সময়ও না।”
“সেটা হলে যে ক্ষতি হতো সেটা হয়তো পরিমাপ করা যেত না। যদি ঘূর্ণিঝড় রাতে আসে এবং জোয়ার এবং সাইক্লোন পতনের সময় একসঙ্গে হয়—সেটা দিয়ে মাপতে হবে সক্ষমতা কতটুকু হয়েছে,” বলেন গওহার নঈম ওয়ারা।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি সর্বোচ্চ ২২৪ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানলে উপকূলীয় এলাকায় ১০ থেকে ৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূল দিয়ে বয়ে গেলেও প্রবল সেই ঘূর্ণিঝড়টি তীব্র আঘাত হেনেছিল ভোলা জেলায়। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়টি ‘দ্য গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’ নামে পরিচিতি পায়।
২০১৭ সালের ১৮ মে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়গুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করে জাতিসংঘের আওতাধীন বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা। সেখানে ভোলায় আঘাত হানা সাইক্লোনটিকেই 'সবচেয়ে শক্তিশালী সাইক্লোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ভোলার ওই সাইক্লোনে কত মানুষ মারা গিয়েছিল, তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসেবে নেই। তবে কারও কারও মতে, ওই ঘূর্ণিঝড় তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।