প্রতিবাদ করে নিষিদ্ধ হওয়া শ্রাবণের পক্ষে শিল্পী–সাহিত্যিকদের অবস্থান
2016.12.27
ধর্ম নিয়ে বিতর্কিত বই প্রকাশ করায় আটক একজন প্রকাশকের মুক্তির দাবি জানিয়ে বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশের আরেকজন খ্যাতিমান প্রকাশক। তার প্রকাশনা সংস্থাটিকে কালো তালিকাভুক্ত করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিও নিষিদ্ধ করেছে বাংলা একাডেমি।
এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিকেরা। মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বাংলা একাডেমির প্রধান ফটকের সামনে মানবন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন তাঁরা।
ওই মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীদের একজন, ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “বাংলা একাডেমি মহাপরিচালকের একটি প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ করার নির্বাহী ক্ষমতা নেই। তিনি (মহাপরিচালক) গায়ের জোরে এটা করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর আইনগত এখতিয়ারই নেই।”
মানবাধিকারকর্মী খুশি কবীর বেনারকে বলেন, “এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলা একাডেমি মুক্তচিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, যা সত্যি ন্যাক্কারজনক।”
ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে।
দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ শ্রাবণ প্রকাশনী
গত বছর বইমেলায় ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে বই প্রকাশ করার অভিযোগে ব-দ্বীপ প্রকাশন নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার বই নিষিদ্ধ করে বাংলা একাডেমি। প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিককেও তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় তাঁর বইয়ের স্টলটিও।
শামসুজ্জোহা মানিকের মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবিন আহসান।
ওই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে রবিন বাংলা একাডেমির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন এমন অভিযোগ এনে আগামী দুই বছরের জন্য তাঁর প্রকাশনা সংস্থা শ্রাবণ প্রকাশনীকে একুশে বই মেলায় নিষিদ্ধ করেছে বাংলা একাডেমি। একইভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ব-দ্বীপ প্রকাশনীও।
এ প্রসঙ্গে বই মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক জালাল আহমেদ বেনারকে বলেন, “গত ১০ নভেম্বর পরিচালনা পরিষদের কাউন্সিলে শ্রাবণ প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এটি মহাপরিচালকের একক সিদ্ধান্ত নয়।”
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “গত বছর ব-দ্বীপকে যখন নিষিদ্ধ করা হয়, তখন অনেকে এর বিরোধিতা করে; যার মধ্যে শ্রাবণের রবিন আহসান ছিলেন। বাংলা একাডেমির কাউন্সিল মনে করছে, তাঁর এ অবস্থান একজন দায়িত্বশীল অংশগ্রহণকারী প্রকাশক হিসেবে যৌক্তিক নয়, মেলার স্বার্থের পরিপন্থি।”
মেলায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আরো তিনটি প্রকাশনা সংস্থাকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে তিনি জানান। এগুলো হলো; ঐক্য প্রকাশনী, নীলপরী প্রকাশনী ও রঙিনফুল প্রকাশনী।
প্রায় দেড় মাস আগে নেওয়া এ সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। বরং ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য বই মেলায় স্টল নেয়ার আবেদনের ফরম তুলতে গিয়ে বিষয়টি জানতে পারে শ্রাবণ কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে রবিন আহসান বেনারকে বলেন, “নিষিদ্ধ করার কারণ জানতে আনুষ্ঠানিক চিঠি চাওয়ায় বাংলা একাডেমির বই মেলা কমিটির পরিচালক জালাল আহমেদ আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন।”
পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক শ্রাবণ প্রকাশনী নিষিদ্ধ হয়েছে—বাংলা একাডেমির এমন দাবি ‘ভুয়া’ উল্লেখ করে তিনি বলেন “পরিচালনা পর্ষদের অনেকেই বিষয়টি জানেন না। তাঁদের অন্ধকারে রেখে, ব্যক্তিগতভাবে মহাপরিচালক কাজটি করেছেন।”
রবিন বলেন, “আমি কখনো বাংলা একাডেমির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিনি। বই প্রকাশের দায়ে একজন প্রকাশক, একজন সহযোদ্ধাকে গ্রেপ্তারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম।”
তিনি বলেন, “বাইরে, টকশোতে বিভিন্ন সময় বাংলা একাডেমির কার্যক্রমের সমালোচনা করেছি। লেখক অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছি। এসব কারণেই বাংলা একাডেমির ভিতরেই কোনো একটি চক্র চাইছে শ্রাবণ প্রকাশনী বন্ধ হোক।”
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানকে দায়ী করে রবিন আহসান বলেন “গত বছর ব-দ্বীপের নিষিদ্ধ হওয়া বইটির কথাই মহাপরিচালক এখন নতুন করে বারবার উচ্চারণ করছেন, যেটা মানুষ ভুলে গিয়েছিল। আমার বিরুদ্ধে মোল্লাদের লেলিয়ে দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার, তা তিনি করছেন।”
তাঁর মতে, এর মাধ্যমে জঙ্গিবাদী ও মৌলবাদিরা উৎসাহিত হবে।
মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন
শ্রাবণ প্রকাশনীকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মুক্তচিন্তার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ এনেছেন বিভিন্ন লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীরা। বাংলা একাডেমির সামনে ‘লেখক, শিল্পী সংস্কৃতিকর্মী ও নাগরিকবৃন্দ’ ব্যানারে আয়োজিত প্রতীকী অবস্থান কর্মসূচিতে তারা এ অভিযোগ আনেন।
মানবন্ধনে লেখক-ব্লগার ও সাংবাদিক আরিফ জেবতিক বলেন, “কোনো প্রকাশনীকে বই মেলায় নিষিদ্ধ করা মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। এই ধরনের মানসিকতার লোকদের অমর একুশের চেতনাসমৃদ্ধ বাংলা একাডেমি থেকে পদত্যাগ করা উচিত।”
খুশী কবির বলেন, “আজকের বাংলা একাডেমি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফসল। সেই চেতনা থেকেই প্রতিবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন করা হয়। এ মেলার মূল শক্তি জনগণ, লেখক আর প্রকাশকেরা।”
তিনি বলেন, “বাংলা একাডেমির মূল কাজ হচ্ছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করা ও বই মেলায় সহযোগিতা করা। কোন প্রকাশনী এতে অংশ নেবে, আর কারা নেবে না—সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির নয়।”
পরে তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলা একাডেমি বই নিষিদ্ধ করছে, প্রকাশনী বন্ধ করছে। এর মাধ্যমে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে সেন্সরশিপ আরোপ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এটা বাংলা একাডেমির কাছ থেকে আশা করা যায় না।”
এদিকে শ্রাবণ প্রকাশনীর বিষয়ে একাডেমির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলা একাডেমির পরিচালক জালাল আহমেদ।
মেলা কমিটির এই পরিচালক জানিয়েছেন, শ্রাবণের পক্ষ থেকে আবেদন করলে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারে একাডেমি।