একদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা, আরেকদিকে অবনতির আশঙ্কা
2024.07.25
ঢাকা

সপ্তাহজুড়ে চলা সহিংসতা ও ব্যাপক হতাহতের ঘটনার পর একদিকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে, আরেকদিকে সরকারের পক্ষ থেকে আবারও পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, “পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, আন্দোলনকারীরা ঘাপটি মেরে বসে আছে।”
আন্দোলন চলাকালে সহিংসতা সৃষ্টিকারীরা রাজধানী ঢাকায় রয়েছে-এমন তথ্য প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা যাতে ঢাকা ছেড়ে যেতে না পারে পুলিশ সেই পরিকল্পনা করেছে।
উল্লেখ্য, সহিংসতার ঘটনায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলোকে দায়ী করে দেশজুড়ে ‘ব্লকড রেইড’ নামে গ্রেপ্তার অভিযান অব্যহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
দেশের বিভিন্ন এলাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উদ্ধৃত করে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, ১৭ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত গত ৮ দিনে সারা দেশে গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার।
বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, “সহিংসতার ঘটনায় করা ২০০টি মামলায় এ পর্যন্ত ঢাকায় দুই হাজারের বেশি নাশকতাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
দুর্বৃত্তরা গত কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে আছে দাবি করে তিনি বলেন, ব্লকড রেইড চলমান রয়েছে। সন্ত্রাসীরা যেখানেই থাকুক, তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হবে।
তবে এই অভিযানের সমালোচনা করে বিএনপি বলছে, মূল ঘটনাকে আড়াল করতেই সরকার বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর ক্রাকডাউন চালাচ্ছে। ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপির মিডিয়া সেল জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার বিকেলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
রাজধানীর বনানীর সেতু ভবনে হামলা ও ভাঙচুরের মামলায় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থকে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর বৃহস্পতিবার ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা আ.লীগের
বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ছাত্রদের ওপর ভর করে বিএনপি-জামায়াত দেশকে ধ্বংস করার পায়তারা করছে।
তিনি বলেন, “বিএনপি বেছে বেছে নতুন নেতৃত্বের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পদায়ন করেছে এবং হামলা পরিচালনার জন্য তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে নিয়োগ করে কে, কোথায় হামলা চালাবে সেই নীলনকশা আগেই প্রস্তুত করে রেখেছিল।”
এদিকে এক বিবৃতিতে বিএনপি কিংবা বিরোধী দলের কেউ সহিংসতার সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানান মির্জা ফখরুল।
মেট্রো রেলস্টেশন পরিদর্শন করলেন প্রধানমন্ত্রী
আন্দোলনের সময় পুড়ে যাওয়া মিরপুর-১০ মেট্রো রেলস্টেশন পরিদর্শন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর কাছে বিচার চেয়েছেন।
“আমি জনগণের কাছে ন্যায়বিচার চাইছি। ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দেওয়ার মতো আমার আর কোনো ভাষা নেই,” বলেন তিনি।
ওই ঘটনার পর থেকে মেট্রোরেল বন্ধ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির এই পরিবহন এভাবে ধ্বংস করেছে তা মানতে পারছি না। মানুষের কষ্ট লাঘবে সরকার যে উন্নয়ন করেছে, সেগুলো যারা ধ্বংস করেছে তাদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে রুখে দাঁড়াতে হবে।
গত শুক্রবার বিকেলে মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়ার মেট্রো স্টেশনে তাণ্ডব চালানো হয়। ভাঙচুর করা হয় সিসি ক্যামেরা, এলইডি মনিটর, টিকিট কাটার মেশিনসহ বিভিন্ন জায়গায়। লুট করা হয় মূল্যবান অনেক জিনিস।
ধ্বংসপ্রাপ্ত স্টেশন দুটি ঠিক করে চালু করতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে বলে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

চার মন্ত্রীর পদত্যাগ চান আন্দোলনকারীরা
বুধবার গভীর রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫২ সমন্বয়কের এক যৌথ বিবৃতি সরকারের চার মন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯টি দাবি তুলে ধরেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদের পাঠানো ওই বিবৃতিতে বলা হয়, “কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে।" ইতোমধ্যে প্রায় তিন শতাধিক ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে এবং কয়েকজন সমন্বয়ককে গুম করে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন তিনি। আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদকে ৫ দিন ইনজেকশন দিয়ে সেন্সলেস অবস্থায় গুম করে নির্যাতন করা হয়েছে এবং বুধবার চোখ বাধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানানো হয় বিবৃতিতে।
বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।”
এতে বলা হয়, ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে চার মন্ত্রী আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান খান, ওবায়দুল কাদের ও মহিবুল হাসান চৌধুরীকে মন্ত্রিপরিষদ এবং দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার রংপুরে একটি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, দাবি আদায় হওয়ার পরও আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা না দেওয়া শিক্ষার্থীদের বড় ভুল।
বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত চায় জাতিসংঘ
সাম্প্রতিক সহিংসতার সব ঘটনার স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক।
বুধবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে ডুজারিক বলেন, “আমি মনে করি, বাংলাদেশে যা ঘটছে, আমরা যা দেখেছি— গণগ্রেপ্তার ও হত্যাকাণ্ড ... সেসব ব্যাপারে আমরা আমাদের উদ্বেগ খুবই স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছি।”
তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়াটাও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। সহিংসতার সব ঘটনা স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত চান তিনি। দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং সংলাপের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রস্তাব করেন তিনি।
পৃথক এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, আন্দোলন চলাকালে সেখান থেকে পাওয়া ভিডিও ও ছবির ক্রমাগত যাচাই ও বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিবাদ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাণঘাতী ও মৃদু প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
ইন্টারনেট পাচ্ছেন ১০ ভাগ মানুষ
সাতদিন বন্ধ থাকার পর বুধবার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু করলেও দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ এখনও ইন্টারনেট সেবার বাইরে আছেন। কারণ সরকারি-বেসরকারি হিসাবে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মোবাইল ডেটা ব্যবহার করেন।
তবে ব্রডব্যান্ড সেবার মাধ্যমে আজ থেকে ইউটিউব এবং গুগল সেবা পাবেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলে জানানো হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) সমিতির সভাপতি আমিনুল হাকিম বৃহস্পতিবার সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা বেনারের কাছে নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, “তবে মেটার সব অ্যাপ যেমন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটক দেখা যাবে না।”
বাংলাদেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫ কোটি, যার মধ্যে মাত্র দেড় কোটি ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. এমদাদুল হক বলেন, ১০ ভাগ সেবা দেওয়ার জন্য নির্মাণ করা অবকাঠামোগুলোতে ৯০ ভাগ ব্যবহারকারীরা চলে আসলে গতি ধীর হওয়াটাই স্বাভাবিক।
অনলাইনে মেয়েদের কাপড়ের ব্যবসা করেন আফসানা শরমি। ‘কল্পতরু’ এর স্বত্ত্বাধিকারী আফসানা বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “ফেসবুক বন্ধ হয়ে আমার ব্যবসার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে।”
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “বর্তমানে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। সরকার হয়তো মনে করছে, পুরোপুরি ইন্টারনেট সেবা থাকলে সহিংসতার চেষ্টা করা হবে। তবে যত দ্রুত সম্ভব ইন্টারনেট সেবা চালু করা উচিত।”
আরও দুই মৃত্যু
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকা আহত দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে পুলিশ আউটপোস্টের এসআই বাচ্চু মিয়া বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ নিয়ে কোট সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় মৃতের সংখ্যা বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে পাওয়া স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর হিসেবে দুইশ পার হয়েছে। যদিও সরকারিভাবে হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি।