মানবপাচার পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ আগের অবস্থানেই
2019.06.20
ঢাকা
মানবপাচার বন্ধে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য চেষ্টা চালালেও সরকার এর জন্য প্রয়োজনীয় নূন্যতম মান নিশ্চিত করছে না। আর সেকারণেই বাংলাদেশের অবস্থান একইরকম রয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবপাচার সম্পর্কিত ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে এমন কথা বলা হয়েছে। গত তিন বছরের মতো এবছরও বাংলাদেশ প্রতিবেদনের দ্বিতীয় ধাপের ওয়াচলিস্টে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সার্বিকভাবে আগের বছরের চেয়ে গত বছর মানবপাচার বন্ধের উদ্যোগে ঘাটতি ছিল। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ও বিদেশে মানবপাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা সরকারের কাছ থেকে সুরক্ষা সেবা পাচ্ছে না।
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর খবর এবং ৬৪ বাংলাদেশি তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকায় ভেসে থাকার ঘটনার মধ্যেই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দেশের যুবকদের যে কোনো উপায়ে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা এবং দেশের অর্থনৈতিক সুফল সবার কাছে সমানভাবে না পৌঁছানোর কারণে মানুষ মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা ও মানব পাচার বিষয়ক গবেষক ড. উত্তম কুমার দাস বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে মানবপাচারকারীরা সক্রিয় থাকার মূল কারণ হলো এখানকার যুবকেরা বিদেশে যাওয়ার জন্য মরিয়া। যেভাবেই হোক বিদেশ যেতেই হবে। সেকারণে মানবপাচারকারীরা সহজে তাদের প্রলুদ্ধ করতে পারে।”
তিনি বলেন, দেশে প্রতি বছর যে সংখ্যায় নতুন কর্মক্ষম মানুষ তৈরি হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান পায় না। আর সে কারণে যুবক–যুবতীরা দেশের বাইরে চলে যেতে চায়।
তাঁর মতে, বৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার পথও খুব সীমিত। সে কারণে তারা অবৈধ পথ বেছে নেয়।
ড. উত্তম বলেন, “আবার মানবপাচারের ব্যাপারে অনেক সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানো হলেও যারা পাচারের শিকার হন তারা মনে করেন যে, তারা কোনও না কোনওভাবে রক্ষা পাবেন। আর সে কারণে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়া বন্ধ করা যাচ্ছে না।”
তাঁর মতে, পাচারকারীরা ধরা পড়লেও তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। মানবপাচার বন্ধ না হওয়ার এটাও বড় কারণ।
মানবপাচার প্রতিরোধ আইন প্রসঙ্গ
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ আইনটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে খুব সামান্য আন্তরিক ছিল সরকার। কিছু আলোচিত মানবপাচার ঘটনার অভিযোগের ব্যাপারে সরকার তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
প্রতিবেদনে মামলার তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, গত বছর মানবপাচার বিরোধী আইনের আওতায় ৫৯২টি মামলা হয়েছে। আর এসব মামলায় ১ হাজার ৩২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়েও কম বলে উল্লেখ করা হয়।
২০১৭ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ আইনের আওতায় ৭৭৮টি মামলা করা হয়েছিল। এসব মামলা অধিকাংশই ছিল রোহিঙ্গাদের পাচার সম্পর্কিত।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, মানবপাচার বিষয়ক কটি মামলা বিচারের জন্য এসেছে অথবা পূর্বের কতগুলো মামলা চলমান রয়েছে সে ব্যাপারে কিছু জানাতে চায় না বাংলাদেশের আদালত।
গত বছর মানবপাচার বিষয়ে মোট পাঁচ মামলায় আট মানবপাচারকারীর বিচার হওয়ার তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব মামলার সবগুলো নারীদের বিদেশে বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদান এবং যৌন কর্মে বাধ্য করা সংক্রান্ত।
পাচারের ঝুঁকিতে রোহিঙ্গারা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের জোর করে কাজ করানো এবং যৌন কর্মে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্নস্থানে নেওয়া হচ্ছে, এমন বিশ্বাসযোগ্য অনেকগুলো ঘটনা জানা গেলেও সরকার এ ব্যাপারে তদন্ত করে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।
রোহিঙ্গাদের দায়ের করা মানবপাচার বিষয়ক কোনো মামলা বাংলাদেশের আদালত আমালে নেয় না বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে সরকার রোহিঙ্গা শিবিরে উল্লেখযোগ্য মানবিক সেবা প্রদান করে এবং পাচার বন্ধে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিকে সহযোগিতা করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভিন্নমত
মার্কিন প্রতিবেদন বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেন, “তারা তো প্রতি বছরই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আমরা তাদের প্রতিবেদনের সাথে একমত নই। সরকার মানবপাচার বন্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না—এ কথা একদম ঠিক না।”
তিনি বলেন, “আমরা তাদের প্রতিবেদন পরীক্ষা করে দেখব। সেখানে যদি ভালো কিছু থাকে তাহলে আমরা সেগুলো গ্রহণ করব।”
সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীরা
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু এই উন্নয়ন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখন পর্যন্ত সকলের জন্য উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়নি। আর সে কারণেই মানুষ যেভাবেই হোক দেশের বাইরে যেতে চায়। আর পাচারকারীরাও সেই সুযোগ নেয়।”
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভালো চাকুরি, বিয়ে অথবা ভালো ভবিষ্যতের কথা বলে তাদের মিথ্যা প্রলোভনে ফেলে বিদেশে পাচার করা হয়।
নূর খান বলেন, “আমরা এখনো এমন কোনো কর্মকৌশল বের করতে পারিনি যার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে মানবপাচারকারীদের হাত থেকে রক্ষা করা যায় অথবা যে কোনো উপায়ে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা যায়।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশিদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমন মানবপাচারকারীদের আরও উৎসাহিত করেছে।
“যেহেতু রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রবিহীন মানুষ এবং তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না, সেহেতু এই মানুষগুলো যেভাবেই হোক বিদেশে যেতে চায়। আর এই সুযোগ নিচ্ছে মানবপাচারকারীরা,” বলেন নূর খান।