নারী কেলেঙ্কারির পর হেফাজতের নেতা মামুনুল হকের নামে সহিংসতার মামলা

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.04.06
ঢাকা
নারী কেলেঙ্কারির পর হেফাজতের নেতা মামুনুল হকের নামে সহিংসতার মামলা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের ভেতর থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট–পাটকেল নিক্ষেপ করেন। ২৬ মার্চ ২০২১।
[বেনারনিউজ]

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে ২৬ মার্চ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকায় সহিংস ঘটনার মামলায় প্রধান আসামী হলেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক, যিনি নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে ৩ এপ্রিল অভিযুক্ত হয়েছেন। 

সোমবার রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় মামুনুল হকসহ হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন বায়তুল মোকাররমে মোদি-বিরোধী সংঘর্ষে আহত যুবলীগ নেতা খন্দকার আরিফ-উজ-জামান। 

মামুনুল ছাড়া হেফাজতের আরও ১৬ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে মামলায় আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন; তিন যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ আল হাবিব, লোকমান হাকিম ও নাসির উদ্দিন মনির, নায়েবে আমীর বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী প্রমুখ।

হেফাজত মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমরা এই মামলার ব্যাপারে এখনও কিছু আলোচনা করিনি। সংগঠনরে ফোরামে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। 

যে অভিযোগে মামলা

মামলার এজাহারের একটি কপি বেনারের হাতে রয়েছে। এতে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, যানবাহন পোড়ানো, বিস্ফোরক দ্রব্যাদির অবৈধ ব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। 

বলা হয়েছে, মামলার বাদী ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনিসহ তাঁর অন্য সহযোগীরা হেফাজতের নেতা ও তাঁদের নেতা–কর্মীদের আক্রমণের শিকার হন।

এজাহারে বলা হয়, মামুনুল হকের প্রত্যক্ষ নির্দেশে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বায়তুল মোকাররমের সামনে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়।

এতে বলা হয়, মামুনুল হক ও অন্য ১৬ আসামীসহ অজ্ঞাত আসামিরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস ও মসজিদ ভাংচুর করে দেশকে অস্থিতিশীল, অকার্যকর ও মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার মাধ্যমে অবৈধ পথে সরকার উৎখাতের হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। 

সরকার-হেফাজত 'মধুচন্দ্রিমা' শেষ!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, “হেফাজতের উত্থান হয়েছিল আওয়ামী লীগের আশীর্বাদে। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতের সহিংস ঘটনার পর সেই মধুচন্দ্রিমার আপাতত অবসান হয়েছে বলা যায়।” 

তিনি বলেন, “আহমেদ শফির মৃত্যুর পরই হেফাজত আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে গেছে। হেফাজতের নেতৃত্ব জুনাইদ বাবুনগরীর হাতে চলে যাওয়ার পর থেকেই বলা হচ্ছিল যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে হেফাজত।”

অধ্যাপক তারেক বলেন, “হেফাজতের তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে মামুনুল হক বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠছিলেন। তাঁর বাবা ইসলামী ঐক্যজোটের প্রধান আল্লামা আজিজুল হক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার-দলীয় ঐক্যজোটের মধ্যে ছিলেন।”

তিনি বলেন, “সুতরাং, বলা যায় মামুনুল হক আওয়ামী লীগের খুব কাছের নন।”

অধ্যাপক তারেক বলেন, “গতকাল মামুনুলের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হয়েছে এই মামলার উদ্দেশ্য হলো তিনিসহ পুরো হেফাজতকে চাপে রাখা।”

তিনি বলেন, “হেফাজতের পক্ষ থেকে যতই মামুনুলের নারী কেলেঙ্কারির ঘটনাকে ঢাকার চেষ্টা করা হোক না কেন এই ঘটনা পুরো সংগঠনের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে এবং করবে।”

তাঁর মতে, অনেকেই মামুনুলকে দলের বোঝা মনে করবেন, দলের মধ্যে বিভেদ বাড়বে এবং সেটিই আওয়ামী লীগ চাইবে।” 

অধ্যাপক তারেক বলেন, “তবে আওয়ামী লীগ হেফাজতকে বেশি দূরে ঠেলবে না। কারণ, আদর্শিকভাবে হেফাজত জামায়াত–শিবিরের বিরুদ্ধে। ভবিষ্যতে তাদের দরকার হতে পারে। তাই আওয়ামী লীগ চাইবে হেফাজত টিকে থাক, তবে তাদের পক্ষেই থাকতে হবে।” 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “হেফাজত হাতছাড়া হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য বড়ো ক্ষতি বলা যায়।” 

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের যে শূন্যতা রয়েছে হেফাজত মূলত সেই শূন্যতা পূরণ করছে বলা যায়। এ জন্য সরকারের ভূমিকা ছিল।”

অধ্যাপক নিজাম বলেন, “আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, হেফাজতের সাথে বিএনপি-জামায়াত যুক্ত হয়েছে। এটা স্বাভাবিক যে, সরকারবিরোধী যে কোনো কার্যক্রমে থাকবে বিএনপি-জামায়াত। কারণ এটা তাদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন।”

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ বলছে তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং গণতান্ত্রিক ধারাকে সামনে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলটি বিএনপিকে গণতান্ত্রিক সুযোগ দিচ্ছে না। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে বিরোধী দলকে সুযোগ দিতে হবে। এটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে বুঝতে হবে।” 

নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ

গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকার একটি অভিজাত রিসোর্টের একটি কক্ষে একজন নারীসহ মামুনুল হককে ঘেরাও স্থানীয় আওয়ামী যুবলীগের কয়েকজন নেতা, এসময় স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকও উপস্থিত ছিলেন।

মামুনুল হক ওই নারীকে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে দাবি করে তাঁর নাম আমিনা তৈয়বা বলে উল্লেখ করেন। তবে ওই নারী নিজের নাম আমিনা তৈয়বা নয় বলে জানান। পরে বেরিয়ে আসে আমিনা তৈয়বা মামুনুল হকের বিবাহিত স্ত্রীর নাম। 

এই ঘটনা জানাজানি হলে হেফাজত নেতা–কর্মীরা জোটবদ্ধ হয়ে মামুনুলকে উদ্ধার করেন। সোমবার এক সভা শেষে ওই নারী মামুনুলের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে উল্লেখ করে হেফাজত। 

মামুনুলকে নিয়ে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী

রোববার সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “যখন আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছি তখন শুরু করল হেফাজতের তাণ্ডব। হেফাজত তো একা নয়, হেফাজতের সাথে জামায়াত-বিএনপিও যোগ দেয়। হেফাজতের সবাই যে এই তাণ্ডবের সাথে যুক্ত তা নয় এটা মনে রাখতে হবে।” 

মামুনুলের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, একদিকে ইসলামের নাম, ধর্মের নাম এবং এতো কিছু বলে যত অপবিত্র কাজ করে ধরা পড়েছে। এখন সেটা ঢাকার জন্য নানা ধরনের প্রচেষ্টা চলছে। 

তিনি বলেন, “যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে তাঁরা এরকম মিথ্যা বলতে পারে, অসত্য কথা বলতে পারে? এটা তো বলতে পারে না। তাহলে এরা কী ধর্ম পালন করে এবং মানুষকে কি ধর্ম শেখাবে?”

শেখ হাসিনা বলেন, “হেফাজতের যারা সদস্য আছেন তাঁদের আমি অনুরোধ করব, তাঁরাও একটু বুঝে নিক কোন নেতৃত্ব তাঁদের! আগুন জ্বালাও, পোড়াও করে তিনি বিনোদন করতে গেলেন একটি রিসোর্টে একটি সুন্দরি মহিলা নিয়ে। এইতো বাস্তবতা। এরা ইসলাম ধর্মের কলঙ্ক। এবং তারা ইসলাম ধর্মকে ছোট করে দিচ্ছে। ধর্মের নামে ব্যবসা করছে।” 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিনোদনের এত অর্থ কোথা থেকে আসে? এর বিচার জনগণ করবে। এবং আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।