রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ আলোচিত ইসলামি বক্তা মাদানী গ্রেপ্তার
2021.04.07
ঢাকা
ইসলামি ‘শিশু বক্তা’ হিসাবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানীকে (২৬) আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার লেটিরকান্দার বাড়ি থেকে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
গত ২৫ মার্চ ঢাকার মতিঝিলে যুব অধিকার পরিষদ আয়োজিত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর বিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে পুলিশের হাতে আটক হয়ে কয়েক ঘণ্টা পর মুক্তি পেয়েছিলেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের অনুসারী এই ইসলামি বক্তা।
শারীরিক উচ্চতা কম থাকায় তিনি ‘শিশু বক্তা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন, যদিও তাঁর বয়স ২৬ বছর।
“রাষ্ট্রবিরোধী ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ায়” তাঁকে আটক করা হয়েছে উল্লেখ করে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বুধবার বেনারকে বলেন, “তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।”
নির্দিষ্ট কোন বক্তব্যের কারণে তাঁকে আটক করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পরবর্তীতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে।”
এদিকে নিজের ফেইসবুকে পেইজে “অবিলম্বে” মাদানীর মুক্তির দাবি জানিয়েছেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক।
মোদি বিরোধী আন্দোলনের আরেক নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুরের পেইজ থেকেও তাঁকে আটকের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়।
এদিকে মাদানীকে দ্রুত মুক্তি না দেওয়া হলে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে বুধবার নেত্রকোনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা।
এ সময় মাদানীর বড় ভাই রমজান মিয়া বলেন, “রাত আড়াইটার দিকে র্যাব পরিচয়ে কিছু লোক ১৯-২০টি গাড়ি নিয়ে তাঁদের বাড়ি ঘেরাও করে।”
তিনি বলেন, তারা মাদানীর সাথে তাঁর ভাই বকুল মিয়া (৩৭) ও দূর সম্পর্কের ভাতিজা এনামুল হককে (২৮) তুলে নিয়ে যায়। পরে শুধু বকুল মিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
রমজানের দাবি, মাদানীর ব্যবহৃত দুটি মুঠোফোনসহ তাঁদের পরিবারের ছয়টি মুঠোফোন জব্দ করেছে র্যাব।
তবে র্যাব কর্মকর্তারা বেনারকে শুধু মাদানীকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছেন।
মাদানীকে আটকের ঘটনায় আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলাম দাবি করেছে, তিনি তাঁর ওয়াজের মাধ্যমে দেশের প্রতি ভালোবাসার তাগিদে সাধারণ মানুষকে অন্যায়, জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানান। রফিকুল ইসলামের মুক্তি দাবি জানিয়ে সংগঠনটির অভিযোগ হচ্ছে, দেশের প্রচলিত আইন অনুসরণ করে তাঁকে আইনের আওতায় নেওয়া হয়নি।
মামুনুলের বিরুদ্ধে নতুন মামলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার রয়্যাল রিসোর্টে গত শনিবার হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক নারীসহ ঘেরাও হওয়ার ঘটনায় ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে তিনটি মামলা হয়েছে।
সোনারগাঁ থানায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও এক সাংবাদিক মামলা দুটি দায়ের করেছেন। যার মধ্যে পুলিশের একটি মামলায় মামুনুল হককে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় কয়েকশ অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বেনারকে বলেন, “হেফাজতে ইসলাম একটি বৃহত্তর সংগঠন। যার জনভিত্তি আছে। এ জন্য সরকার মামলা দিয়ে হয়রানির মাধ্যমে হেফাজতের নেতৃবৃন্দকে দুর্বল করতে চায়।”
তিনি বলেন, “মোদি বিরোধী বিক্ষোভে আমাদের লোক মারা গেছে, আহত হয়েছে, ক্ষতিও হয়েছে আমাদের, আবার মামলার আসামিও হলাম আমরা; রাষ্ট্রযন্ত্রের এই ফ্যাসিবাদী আচরণ আর চলতে দেওয়া যায় না।”
“আমাদের পক্ষ থেকেও মামলা হবে,” যোগ করেন তিনি।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে পরিস্থিতি
সরকার শুরুতেই ব্যবস্থা না নিয়ে হেফাজতকে তাণ্ডব করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং পরবর্তীতে হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকারি দলের সক্রিয়তা তাদের উসকানি দিয়েছে বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মহাসচিব নূর খান লিটন।
“এখন হয়তো চাপে রেখে সরকার আবার তাদের সাথে সমঝোতা করতে চায়। ইতিপূর্বেও আমরা এমন নজির দেখেছি,” বলেন লিটন।
তবে হেফাজতকে চাপে রাখার জন্য সরকার তাঁদের নেতাদের ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁসের মতো যে ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে, তা নৈতিকতার মাপকাঠিতে অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কারো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় সামনে এনে তাঁকে সমাজের সামনে পচিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয়।”
হেফাজতে ইসলামের হরতালে সহিংসতার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় মঙ্গলবার রাতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) এক নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিএনপি নেতা মো. ইকবাল হোসেনকে সিদ্ধিরগঞ্জের নিজ বাসা থেকে আটক করেছে র্যাব।
এ ঘটনাটি উল্লেখ করে হেফাজতের তাণ্ডবের পর বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ও তাঁদের গ্রেপ্তার করার সমালোচনা করেন নূর খান লিটন।
“বিএনপি বা সংসদীয় পদ্ধতির প্রতি যাদের বিশ্বাস আছে, তেমন গণতান্ত্রিক শক্তিকে রাষ্ট্র থেকে উচ্ছেদ বা নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়ায় গেলে তখন কোনো না কোনো শক্তি সেই জায়গাটা পূরণ করবেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বাংলাদেশে এটা পূরণ করতে যাচ্ছে একটি উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠী,” বলেন তিনি।
এদিকে এক সংবাদ সম্মেলনে বুধবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবি করেন, হেফাজতে ইসলাম দেশের শান্তি বিনষ্টে বিভিন্ন জায়গায় যে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে তা সহনশীলতার সব মাত্রা অতিক্রম করেছে।
“সন্ত্রাস, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উস্কানিদাতাদের তালিকা তৈরি করে এদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে,” বলেন তিনি।