হেফাজতের এক শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার, আহমদ শফী ‘হত্যায়’ অভিযুক্ত আমির বাবুনগরী
2021.04.12
ঢাকা
প্রায় আট বছর আগের এক মামলায় গ্রেপ্তার হেফাজতে ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতা আজিজুল ইসলাম ইসলামাবাদীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোমবার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের পর এটিই হেফাজতের কোনো শীর্ষ নেতার প্রথম গ্রেপ্তারের ঘটনা। হেফাজতের সাম্প্রতিক মোদি বিরোধী আন্দোলন ও সহিংসতায় পুলিশের হিসাবে সারা দেশে অন্তত ১৮ জন নিহত হয়েছেন।
হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুলকে ২০১৩ সালে ঢাকায় সহিংসতা ঘটানোর মামলায় রোববার চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বেনারকে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র ইফতেখায়রুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল হেফাজতে ইসলাম অবরোধ কর্মসূচির নামে লাঠি-সোটা ও অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বর ও পল্টন থানা এলাকায় যানবাহন ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ওই বছর ৬ এপ্রিল মতিঝিল ও পল্টন থানায় মামলা রুজু হয়েছিল।
আজিজুল ওইসব মামলার এজাহারভুক্ত আসামি জানিয়ে ইফতেখায়রুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত সোমবার তাঁর সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেছিলেন, “হেফাজতকে কোনো ছাড় নয়। তারা যেভাবে নৃশংসতা চালিয়েছে, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদ ধ্বংস করেছে এতে প্রমাণ হয় তারা সন্ত্রাসী সংগঠন। এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।”
“তারা ২০১৩ সালে দেশে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। আমরা অনেক সহ্য করেছি। আর নয়,” জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “২০১৩ সালের ঘটনায় দায়ের মামলাগুলো সচল করা হচ্ছে।”
মন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর ২০১৩ সালের মামলায় ইসলামাবাদীকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ।
হেফাজতের সহ-অর্থ সম্পাদক মুফতি ইলিয়াস হামিদীকেও নারায়ণগঞ্জ থেকে আটক করা হয়েছে বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হলেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তাঁকে আটকের কথা নিশ্চিত করেনি।
নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে গত ২৫ থেকে ২৭ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সহিংস ঘটনায় সোমবার পর্যন্ত ৭৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪৫টি, চট্টগ্রামে ১০টি, ঢাকায় সাতটি ও বাকিগুলো দেশের অন্যান্য স্থানে করা হয়েছে বলে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
মামলাগুলোর আওতায় চট্টগ্রাম বিভাগে “কমপক্ষে ১৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে হেফাজতের বেশকিছু নেতাকর্মী রয়েছেন,” সোমবার বেনারকে জানান চট্টগ্রাম পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেন খান।
এদিকে গ্রেপ্তার হেফাজতের সকল নেতাকর্মীকে নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে এবং তাঁদের ওপর ‘নির্যাতন’ বন্ধ করা না হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে সোমবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী।
“এত জুলুমের পরও হেফাজতে ইসলাম অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। সরকার প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হেফাজতে ইসলামের সরলতাকে দুর্বলতা মনে করলে এর চরম মাশুল দিতে হবে,” বিবৃতিতে বলেন বাবুনগরী।
অভিযুক্ত বাবুনগরী
বাবুনগরীর বিরুদ্ধেও সোমবার পুলিশের ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর মারা যান হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমির শাহ আহমদ শফী। আহমদ শফীকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে বলে বাবুনগরীসহ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে ১৭ ডিসেম্বর আদালতে মামলা করেন তাঁর এক আত্মীয় মো. মঈন উদ্দীন।
বাদী অভিযোগ করেন, আহমদ শফীকে “মানসিক নির্যাতন এবং তাঁর অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।”
ওই মামলায় বাবুনগরী, মামুনুল হক ও আজিজুলসহ ৪৩ জনের বিরুদ্ধে সোমবার চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল তৃতীয় জজ আদালতে পিবিআই প্রতিবেদন দাখিল করে বলে বেনারকে জানান সংস্থার ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।
হেফাজত ছাড় পাবে না
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে কওমি মাদ্রাসাগুলোর নেতৃবৃন্দ চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ শফীর নেতৃত্বে “ইসলামকে রক্ষা করতে” হেফাজতে ইসলাম গঠন করেন।
অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে ঠেকাতে আদর্শিকভাবে ভিন্ন ধারার হেফাজতে ইসলামকে সমর্থন ও সহায়তা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
দেশে ইসলাম ধর্ম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত নাস্তিক-ব্লগারদের ফাঁসির দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে সারা দেশ থেকে মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে সমাবেশ করে ঢাকার শাপলা চত্বর দখল করে হেফাজতে ইসলাম। গভীর রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে সেই ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে।
এই ঘটনায় কমপক্ষে ৮৩টি মামলা দায়ের করেছিল পুলিশ। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেসব মামলা তদন্তে অগ্রগতি নেই।
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে গত ২৫ থেকে ২৭ মার্চ থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করে হেফাজত, যা পরে সহিংসতায় রূপ নেয়।
এর প্রেক্ষিতে হেফাজতে ইসলামকে ‘উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তি’ হিসাবে আখ্যায়িত করে বুধবার এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, হেফাজত দেশের বিভিন্ন স্থানে যে “অব্যাহত তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে তা সহনশীলতার সব মাত্রা অতিক্রম করেছে।”
তিনি বলেন, “দেশের জনগণের ধৈর্য ও সহনশীলতার একটা সীমা আছে! সীমা অতিক্রম করলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদের মতে, নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতের সহিংসতা বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে।
“সুতরাং, আমার মনে হয় সরকার হেফাজতকে আর বড়ো রাজনৈতিক শক্তি হতে দেবে না,” বেনারকে বলেন অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন।
“হেফাজত কখনো আওয়ামী লীগের ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির সাথে মিলতে পারবে না,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সুতরাং, বিএনপি-জামায়াতকে শায়েস্তা করার জন্য আওয়ামী লীগ হেফাজতকে ব্যবহার করলেও ভবিষ্যতে তাদের সাথে সংঘর্ষ হতে বাধ্য। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তা-ই প্রমাণ করে।”
এদিকে “আওয়ামী লীগ কখনোই ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনকে সমর্থন দেয়নি,” জানিয়ে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “কিছু কারণে এতদিন হেফাজতের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে এবার তারা আর ছাড় পাবে না।”