পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এক সপ্তাহের রিমান্ডে হেফাজতের মামুনুল
2021.04.19
ঢাকা
একটি পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোমবার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
বেনারকে এই তথ্য জানিয়ে পুলিশের উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) জাফর হোসেন বলেন, গত বছরের মার্চে মোহাম্মপুরের একটি মসজিদে কয়েকজন মুসল্লিকে মারধরের ঘটনায় মামুনুলের সংশ্লিষ্টতার দায়ে রোববার তাঁকে মোহাম্মপুরের জামিয়া মোহাম্মদীয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে আটক করে পুলিশ।
মামুনুলের রিমান্ড সোমবার শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “রিমান্ড শেষে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হবে।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে মার্চ ২৬-২৭ দেশব্যাপী সহিংসতার পর মামুনুলসহ হেফাজতের কমপক্ষে ছয় কেন্দ্রীয় নেতা এবং শতাধিক কর্মী-সমর্থক আটক হয়েছেন।
মামুনুলের আইনজীবী ও বিশ্লেষকদের মতে, পুরাতন মামলায় গ্রেপ্তার করা হলেও মূলত ‘রাজনৈতিক’ কারণেই হেফাজতের নেতা–কর্মীদের আটক করা হচ্ছে।
মোদির বাংলাদেশ সফরের পরবর্তী সময়ে আটক হেফাজতের অন্য পাঁচ নেতা হলেন; সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল ইসলাম ইসলামাবাদী, যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের সভাপতি মোহাম্মদ জুনায়েদ আল হাবীব, সহকারী মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা মহানগরীর ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলানা জুবায়ের আহমেদ ও ঢাকা মহানগর হেফাজত ইসলামের সহ–সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফউল্লাহ।
এদের সবাইকেই আটক করা হয়েছে পুরনো বিভিন্ন মামলার আসামি হিসেবে।
হেফাজতের আরো বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতা নজরদারিতে রয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মামুনুল হক আটকের প্রতিবাদে সোমবার হেফাজত কর্মীরা বাগেরহাটের মোল্লাহাটে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার কে এম আরিফুল হক।
তিনি বলেন, হামলার ঘটনায় এক পুলিশ কনস্টেবল আহত হয়েছেন। ওই ঘটনায় হেফাজতের কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলে জানান তিনি।
তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ উপকমিশনার হারুনুর রশীদ রোববার সাংবাদিকদের বলেন, মামুনুল হকের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস, সহিংসতায় উস্কানি দেয়াসহ বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে।
এখন তাঁকে পুরনো একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হলেও অন্য সব মামলায়ও তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হতে পারে বলে জানান তিনি।
এর আগে গত ৩ এপ্রিল একজন নারীসহ নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে গিয়ে স্থানীয়দের হামলার মুখে পড়েন মামুনুল। পরে হেফাজতের স্থানীয় কর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করেন।
মারধরের অভিযোগ
আদালতে দাখিল করা পুলিশি আবেদনের একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে। এই আবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ৬ মার্চ রাত আটটা ৪০ মিনিটে মোহাম্মদপুর সাত মসজিদ এলাকার সাত গম্বুজ মসজিদে আমল করছিলেন আসাদুর রহমান (৫৭), আব্দুল মোত্তালিব (৬৫), মিজানুর রহমান (৬৭), আলী মোর্শেদ (৪৬), ইয়াকুব আলী (৪৪), শফিক (৩০), আরব রহমান (৩৫) ও হাজী ইউসুফ (৪৮)।
এসময় মামুনুল হক ও তাঁর ভাই মোহতামিম মাহফুজুল হকের নির্দেশে জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা তাঁদের মসজিদ থেকে বের হয়ে যেতে বলে।
এতে বলা হয়, এরপর মাদ্রাসার ছাত্ররা ওই মুসল্লিদের পিটিয়ে জখম করে এবং তাঁদের ফোন ও টাকা কেড়ে নেয়। এই ঘটনায় মামুনুল হক নির্দেশদাতা।
ওই ঘটনায় মামুনুলসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
পুলিশ জানায়, মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ও ভাংচুরের কমপক্ষে অর্ধডজন মামলা রয়েছে।
‘রাজনৈতিক’ কারণে আটক
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনজীবীরা বলছেন, মূলত মোদি বিরোধী সহিংসতার কারণেই মামুনুল হকসহ হেফাজতের নেতা–কর্মীদের পুরনো মামলায় আটক করা হচ্ছে।
মামুনুল হকের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন মিসবাহ সোমবার বেনারকে বলেন, “সরকার মামুনুল হককে রাজনৈতিক কারণে আটক করেছে। আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটির কোনো ভিত্তি নেই।”
তিনি বলেন, “মামুনুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মোহাম্মদপুরের একটি মসজিদে বাদীকে মারধর করার নির্দেশ দিয়েছেন। কী নির্দেশ দিয়েছেন সেটি বলা নাই।”
প্রায় এক বছর আগের মামলাটির বিষয়ে “পুলিশ এতদিন কিছু করেনি,” এবং মামুনুল ওই মামলার সাত নম্বর আসামি জানিয়ে মিসবাহ বলেন, “মারামারির মামলায় তাঁকে রিমান্ডে নেয়ার কোনো বিধান নেই।”
“বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার কারণে” মামুনুলকে পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন মিসবাহ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর নেতৃত্ব পরিবর্তন হওয়ার পর থেকেই মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে সংগঠনটি।
তিনি বলেন, আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের নেতৃত্ব থেকে শফীর ছেলে আনাস মাদানীসহ তাঁর অনুসারীরা একপেশে হয়ে পড়েছেন। তাঁরা মূলত হেফাজতের কার্যক্রমে সক্রিয় নেই।
তাঁর মতে, “পুরনো মারামারির মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলেও মূলত নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতের সহিংস কর্মসূচির পরই আওয়ামী লীগের টনক নড়ে। এখন তারা আপাতত আর হেফাজতকে সমর্থন দেবে না।”
হেফাজতের সাথে সরকারের সম্পর্ক ও কার্যক্রম নিয়ে বেনারের সাথে কথা বলেছেন গবেষক ও লেখক আফসান চৌধুরী।
তাঁর মতে হেফাজত “সরকারকে ফেলে দিতে পারবে” বলে নিজেরা মনে করলেও এর আগে ২০১৩ সালের ৫ মে এমন একটি কর্মসূচি দিয়ে তারা “পিছু হটতে বাধ্য হয়।”
“প্রকৃতপক্ষে তারা সরকারের সাথে লড়াই করে কিছুই করতে পারবে না,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, হেফাজত গ্রামের মসজিদ ও মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন। “হেফাজতের নিজস্ব কোনো অর্থনীতি নেই। এই সংগঠন চলে গ্রামের মানুষের সাহায্য–সহায়তার অর্থে।”
“যাঁরা হেফাজতকে টাকা দেন, তাঁরা হেফাজতের পক্ষে সরকারের বিপক্ষে রাস্তায় মরতে যাবে না। তা ছাড়া লড়াই করতে হলেও তো অর্থ প্রয়োজন, হেফাজতের সেটি নেই,” বলেন আফসান চৌধুরী।
সরকার ২০১৩ সালের পুরনো মামলা চালু করার পাশাপাশি নতুন মামলা দায়ের করছে, এর ফলে “হেফাজত আর মাথা তুলতে পারবে না,” বলে মনে করেন তিনি।
“সরকার হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বকে চায় না; বাবুনগরী-মামুনুলকে চায় না। চায় শফীর ছেলেকে,” জানিয়ে আফসান চৌধুরী বলেন, “মোদি বিরোধী আন্দোলনের নামে সহিংসতার কারণে সরকারের সামনে একটি সুযোগ এসেছে। এখন হেফাজতের নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেও বিস্মিত হব না।”
এদিকে হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে শনিবার দেশের ৫১ জন আলেম বিবৃতি দেন। এরপর রোববার আরও ৬২ জন আলেম হেফাজতের বর্তমান রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিদুষ্ট নেতৃত্ব বর্জনের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান।
মওলানা কাফিল উদ্দীন সরকার সালেহীসহ ৬২ জনের স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করার দাবি জানান।
প্রসঙ্গত, মোদি বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। এইসব সহিংসতায় কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে তাঁরা সতর্ক করার পর থেকেই বিভিন্ন পুরনো মামলায় একের পর এক গ্রেপ্তার হচ্ছেন হেফাজতের নেতারা।