হেফাজতে প্রকাশ্য বিভক্তি: বাবুনগরীর গ্রেপ্তার চান মাদানীপন্থীরা
2021.06.02
ঢাকা

হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শফী ‘হত্যাকাণ্ডে’ সম্পৃক্ত থাকার দায়ে সংগঠনটির বর্তমান আহ্বায়ক জুনায়েদ বাবুনগরীর গ্রেপ্তার দাবি করেছেন শফীপুত্র আনাস মাদানী-সমর্থক নেতারা।
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে আনাস মাদানীকে পাশে রেখে সরকারের কাছে এই দাবি জানান সংগঠনটির সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি ফয়জুল্লাহ।
গত ২৬ মার্চ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকাসহ দেশজুড়ে তাণ্ডব চালায় বাবুনগরীর সমর্থকেরা, এসব ঘটনার জের ধরে এই গ্রুপের সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে দুই ডজনের বেশি কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বড়ো নেতাদের মধ্যে বাইরে আছেন বাবুনগরী।
এদিকে গত বছর সেপ্টেম্বরে আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের বাদ পড়া নেতারা এই প্রথমবারের মতো সংগঠনটির বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে দলটির বিভক্তি স্পষ্ট করলেন।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের তদন্তে জুনায়েদ বাবুনগরীসহ তাঁর সমর্থকেরা আহমদ শফীকে ‘হত্যা’ অথবা ‘হত্যার উস্কানি’ দেবার জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন জানিয়ে ফয়জুল্লাহ বলেন, “জুনায়েদ বাবুনগরীসহ তাঁর অনুসারীরা হেফাজতের নেতৃত্বে থাকতে পারেন না।”
তাঁরা অচিরেই হেফাজতে ইসলামের পূর্ণ কমিটি ঘোষণা করবেন বলে জানান তিনি। উল্লেখ্য, বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন হেফাজত মূল কমিটি বাতিল করে বর্তমানে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
বাবুনগরী সমর্থকরা হেফাজতের নেতা–কর্মী নন জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে আহমদ শফীর রেখে যাওয়া সকল প্রতিষ্ঠান থেকে শফী বিরোধীদের অপসারণ করতে সরকারের কাছে দাবি জানান সংগঠনটির আরেক নেতা নুরুল ইসলাম জাদিদ।
তবে আজকে যারা সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন তাঁরা “হেফাজত নয়” মন্তব্য করে জুনায়েদ বাবুনগরীর সমর্থক ও হেফাজতের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির অন্যমত শীর্ষ নেতা নুরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “তাঁদের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।”
“তাঁরা জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেপ্তারের দাবি করেছেন। সরকার গ্রেপ্তার করলে করুক, অসুবিধা নেই” জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি এর বাইরে আর কিছু বলতে চাই না।”
‘শফীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়’
বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে জুনায়েদ বাবুনগরীর কোনো সমর্থককে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন নুরুল ইসলাম জাদিদ। তিনি বলেন, “আহমদ শফীর মৃত্যুর তিনদিন আগে হাটহাজারীতে নারকীয় তাণ্ডব ও ধ্বংস চালানো হয়েছে।”
“জীবনের শেষ মুহূর্তে মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে (শফী) অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করতে দেয়া হয়নি, রুমের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল, এসি-ফ্যানসহ আসবাবপত্র ভাংচুর করা হয়েছিল।”
জবরদস্তি করে শফীকে হেফাজত থেকে “পদত্যাগে বাধ্য করা হয়” জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁকে যাতে হাসপাতালে নিতে দেরি হয় সেজন্য অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখা হয়েছিল।
তিনি বলেন, আহমদ শফীর মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে আখ্যা দিয়ে মিথ্যাচার করেছেন বাবুনগরী।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর মারা যান হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমির শাহ আহমদ শফী। শফীকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে বলে বাবুনগরীসহ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে ১৭ ডিসেম্বর আদালতে মামলা করেন তাঁর এক আত্মীয় মো. মঈন উদ্দীন।
গত ১৩ এপ্রিল আদালতে এই হত্যা মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। এতে বাবুনগরীসহ মোট ৪৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদন অনুসারে অভিযুক্তদের অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
সরকার ‘ছাড় দেবে না’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে গত ২৬ মার্চ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকাসহ সারাদেশে নারকীয় তাণ্ডব চালায় শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের নেতৃত্বে আসা বাবুনগরীর সমর্থকরা।
ওই সহিংসতায় কমপক্ষে ১৮ জন প্রাণ হারান, যাদের প্রায় সবাই হেফাজত সমর্থক। তবে শফীপন্থীরা এই সহিংসতায় জড়িত ছিলেন না বলে জানিয়েছেন নেতারা।
এই সহিংসতার পর সারাদেশে শতাধিক মামলা দায়ের করে পুলিশ ও বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা।
সরকারের সাথে সমঝোতার জন্য হেফাজত নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেন। তবে সরকারের সাথে কোনো আপস হয়নি।
মোদি বিরোধী সহিংসতাসহ ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের সহিংসতার মামলাগুলো চালু করে সরকার। এপ্রিলের শুরু থেকে একের পর এক গ্রেপ্তার হতে থাকেন বাবুনগরীপন্থী কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। এ পর্যন্ত দুই ডজনের বেশি কেন্দ্রীয় নেতা আটক হয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
সুনামগঞ্জ জেলার সাবেক সংসদ-সদস্য ও হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা শাহিনুর পাশা চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আহমদ আবদুল কাদের ও খালেদ সাইফুল্লাহ, কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্মমহাসচিব মামুনুল হক, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল ইসলামাবাদী, কেন্দ্রীয় সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন ও অন্যান্য নেতারা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
তবে শফীপুত্র আনাস মাদানীর সমর্থক কোনো হেফাজত নেতা আটক হননি।
“ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলাম যে সহিংস কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তা সরকারের জন্য একটি বার্তা। এই ঘটনার পর সরকার কঠোর হয়েছে,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার।
“হেফাজত নেতারা সরকারের সাথে আপস করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাজ হয়নি,” জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার হেফাজতকে “ছাড় দেবে বলে মনে হয় না।”
“সরকারের সাথে সখ্য রক্ষা করে চলতেন আহমদ শফী। তাঁর মৃত্যুর পর হেফাজত সরকারের কাছ থেকে চলে যায়,” বেনারকে জানান রাজনৈতিক গবেষক আফসান চৌধুরী।
তিনি বলেন “শফীর ছেলে আনাস মাদানীকে সরকার হেফাজতের নেতৃত্বে দেখতে চায়। মাদানী নেতৃত্বে আসলে হেফাজত আবার সরকারের হাতে চলে আসবে।”
“হেফাজত গ্রাম্য সংগঠন,” জানিয়ে আফসান চৌধুরী বলেন, “হেফাজতকে হাতে রাখলে অনেক গ্রাম্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সুতরাং, সরকার এই সুযোগ ছাড়বে না।”