তনু হত্যার বিচার দাবিতে ক্ষোভে উত্তাল সারা দেশ

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.03.29
160329-BD-tonu-protest-620.jpg তনু হত্যার বিচার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে জড়ো হয়ে বিভিন্ন স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। ২৯ মার্চ ২০১৬।
ফোকাস বাংলা

নয় দিনেও কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে গোটা দেশ। দল মত নির্বিশেষে সবাই এখন বিচারের দাবিতে সোচ্চার। এরই মধ্যে তনুর লাশ কবর থেকে উত্তোলনে পুলিশের আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী তনু হত্যাকাণ্ড কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার ভেতরে হওয়ায় প্রথমে খবরটি জাতীয় গণমাধ্যমে গুরুত্ব পায়নি। তবে নাগরিক সমাজ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে তা এখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

তনু হত্যার বিচারের দাবিতে গত কয়েক দিনে সারা দেশজুড়ে পালন হয়েছে শতাধিক প্রতিবাদ কর্মসূচি। মঙ্গলবারও ঢাকার বিভিন্ন স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে। সেখানে সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখার মত ঘটনাও ঘটে।

সারা দেশে ক্ষোভ-বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ । আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সিআইডির একটি দল কুমিল্লায় যাওয়ার মধ্যে মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে এই আহ্বান জানানো হয় ।

তোলা হবে তনুর লাশ, কবরে পাহারা

তনু হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভ চলার মধ্যেও খুনি চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার না হওয়ায় গত শনিবার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি)। তবে মামলাটি মঙ্গলবার দুপুরে আবার ডিবি থেকে আবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়েছে।

মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনজুর আলম কুমিল্লা ডিবির ওসি মোহাম্মদ মনজুর আলমের আবেদনের প্রেক্ষিতে সোমবার জেলার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জয়নাব বেগম তনুর লাশ তুলে পুনরায় ময়নাতদন্তের আদেশ দেন।

“অধিকতর তদন্তের স্বার্থে আমাদের আবেদনের পর আদালত লাশ উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা চলছে। আগামীকাল (বুধবার) লাশটি কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হবে,” বেনারকে জানান মনজুর আলম।

তিনি জানান, তনুর ব্যবহৃত পোশাক ও শরীরে পাওয়া অন্যান্য আলামত পরীক্ষার জন্য ঢাকায় সিআইডির পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে লাশ পাওয়ার পর প্রাথমিক যে ময়নাতদন্ত করা হয়, সে প্রতিবেদন এখনো হাতে আসেনি।

“আদালতের আদেশের পর তনুর কবর পাহারায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। লাশ না তোলা পর্যন্ত পুলিশ সেখানে থাকবে,” বলেন কুমিল্লার মুরাদনগর থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।

সেনাবাহিনী বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে আইএসপিআর

দেশের প্রতিটি সেনানিবাস সংরক্ষিত এলাকা। তনু হত্যাকাণ্ডটি কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় হওয়ায় এই বাহিনীর গুটিকয়েক সদস্যের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে মঙ্গলবার এক মানববন্ধনে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য নুর আহমেদ বকুল বলেন, “সেনানিবাস এলাকা বলে মামলার তদন্তকাজ বিঘ্নিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অথচ সেনাবাহিনী দেশের মানুষের আস্থার জায়গা। তাই তনু হত্যার সুষ্ঠু তদন্তে সহায়তা করে সেনাবাহিনীকে তাদের ভাবমূর্তি রক্ষার করতে হবে।”

অপর এক অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য শামসুদ্দিন তালুকদার দুলু বলেন, “মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য সেনাবাহিনীকে স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক মনে করা হয়। অথচ একজন মেধাবী শিক্ষার্থী কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পরে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দোষীদের ধরতে সেনাবাহিনীকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।”

তনু হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দেয় বাংলাদেশের আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। এতে বলা হয়, গত ২০ মার্চ তারিখ রাত আনুমানিক ১১ টায় কুমিল্লা সেনানিবাসের সীমানা সংলগ্ন এলাকায় (এস্থানে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই) সোহাগী জাহান তনুর অচেতন দেহ খুঁজে পান তার বাবা ইয়ার আলী এবং তিনি মিলিটারি পুলিশকে খবর দেন। এরপর তাকে তৎক্ষণাৎ সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে পুলিশ ময়নাতদন্ত করে।

আইএসপিআর জানায়, সোহাগী হত্যার কারণ উদ্‌ঘাটনে এর মধ্যেই কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং একাজে সেনাবাহিনী পুলিশ ও প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে।

সেনাবাহিনীর গাড়ি আটক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট

তনু হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে না পারায় মঙ্গলবার রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ​স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা। অবরোধ চলাকালে সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িটি আটকে দেয় অবরোধকারীরা। এ সময় তারা তনু হত্যার বিচার চেয়ে লেখা পোস্টার গাড়িটিতে লাগিয়ে দেয়।

অবরোধ কর্মসূচি থেকে বিচার দাবিতে আগামী ৩ এপ্রিল সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। তবে ওই দিনের এইচএসসি পরীক্ষা ধর্মঘটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে।

শাহবাগের অবরোধে অংশ নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারাহ নাজ বেনারকে বলেন, “তনু এ সমাজের বাইরের কেউ নন। আমাদের মতই শিক্ষার্থী। দেশর সংরক্ষিত এলাকা সেনানিবাসে যদি তাকে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে, তবে আমরা কেউই নিরাপদ নই। আমরা শাহবাগ অবরোধ করেছি। আমরা তনু হত্যার বিচার চাই।”

অবরোধে ফুঁসে ওঠে শাহবাগ এলাকা। যান চলাচল বন্ধ হওয়ায় শহরজুড়ে সৃষ্টি হয় যানজট। দেশের বিভিন্ন স্থানেও তনু হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠন।

তনুর স্বজনদের জিজ্ঞাসাবাদ

অপরাধী আটক না হলেও তনু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাঁর মা-বাবা ও স্বজনদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা। গত শুক্রবার মধ্যরাতে তনুর পরিবারকে গ্রামের বাড়ি থেকে কুমিল্লা সেনানিবাসে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার স্বজনদের অভিযোগ, তনুর সঙ্গে তার কলেজের কোনো শিক্ষার্থীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল এমন স্বীকারোক্তি আদায়ে তাঁদের চাপ দেওয়া হচ্ছে।

তনুর ভাই নাজমুল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের মা আনোয়ারা বেগম ও বাবা মো. ইয়ার হোসেনসহ পুরো পরিবার গ্রামে ফিরে যেতে চাইলেও তাদের বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি এ বিসয়ে কথা বলার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ রয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাস

তনু হত্যার প্রায় এক সপ্তাহ পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সেনানিবাসের মতো সুরক্ষিত এলাকায় কীভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সোমবার ঢাকার মুন্সিগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা জানান।

সেনা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় খুন বলে তদন্ত বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান খান বলেন, “গোয়েন্দারা কাজ করছে, পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্ত কমিটিও হয়েছে। আলামত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। অন্য সব হত্যাকাণ্ডের মতো তনু হত্যাকাণ্ডেরও রহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে।”

পুলিশের আহ্বান

মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “কোনো হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য কোনো আন্দোলন বা বিক্ষোভের প্রয়োজন নেই। সমব্যথী সকলকে ধৈর্য ধরে পুলিশি তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।”

তদন্তে সময় লাগার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “তনু হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্যে ঘটেনি। তাই সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সাক্ষ্য সংগ্রহ করা সময় সাপেক্ষ।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।