আদিবাসী সংখ্যা দেখানো হচ্ছে কম, কমছে না নির্যাতন
2017.02.27
বাংলাদেশে সরকারি জনগণনায় আদিবাসীদের সংখ্যা কম করে দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন আদিবাসী নেতারা। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, মর্যাদা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তাঁরা।
ঢাকায় মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ২০১৬ সালে অন্তত: ১৭ জন আদিবাসী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ভূমি বিরোধের কারণে নিহত হন ৫ জন।
গত বছরের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে সমতল ও পাহাড় মিলিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ১০ জন মানুষ বিভিন্ন সহিংসতায় নিহত হন। এর মধ্যে ভূমিকেন্দ্রিক সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা ছিল মাত্র একজন।
গত রোববার ঢাকায় এই প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। বেশ কিছু আদিবাসীকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করার অভিযোগও তোলা হয়।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী সমতলের আদিবাসীরা আগের চেয়ে অধিক মাত্রায় সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় দখলের জন্য আক্রমণ বেড়েছে।
গাইবান্ধায় পুলিশের গুলিতে ৩ আদিবাসী সাঁওতালের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ‘সবচেয়ে ভয়ানক ও নৃশংস ঘটনা’ হিসেবে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
শুরুতেই আদিবাসী জনগণনার প্রসঙ্গটি এনে কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, “পৃথক পরিসংখ্যান না থাকায় আদিবাসী জাতি ভিত্তিক সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সরকারি তথ্যের লভ্যতা এখনো একটি উদ্বেগজনক ও হতাশাজনক বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে।”
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে আদিবাসী জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ ৮৭ হাজার, যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১ দশমিক ৮০ ভাগ। কিন্তু আদিবাসী নেতাদের মতে, পাহাড়ি বাদ দিয়ে কেবল সমতলেই ২০ লাখের বেশি আদিবাসী বসবাস করেন।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব একেএম মোজাম্মেল হক জনগণনা নিয়ে এই অভিযোগ সম্পর্কে বেনারের কাছে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করতে রাজি হননি।
“ডাটা ফিগারে কোনো সমস্যা থাকলে সেটা ভালোভাবে পর্যালোচনা করে তারপর কথা বলা দরকার। একটি অভিযোগ আসলে সঙ্গে সঙ্গেই তা মেনে নেওয়া বা খারিজ করে দেওয়ার পক্ষপাতি আমি নই। কয়েক দিন সময় দিলে এ বিষয়ে কথা বলতে পারি,” বেনারকে জানান সচিব।
কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন রবীন্দ্রনাথ সরেন বেনারকে বলেছেন, “বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও ৫৪ টির বেশি আদিবাসী জাতি শত শত বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। এর সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হচ্ছে না।”
তাঁর মতে, “আদমশুমারিতে বহু এলাকায় আদিবাসীদের হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা বাঙালি হিসেবে দেখানো হয়েছে। ফলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা হিসাবে আসেনি।”
আদিবাসীদের ওপর ভূমি দস্যুদের উৎপাত অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে বলে তাঁর অভিযোগ।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, “মূলত: জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় এ রকম হচ্ছে। আদিবাসীদের জমি দখলের জন্য তাদের ওপর হামলা, হত্যা ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। এটা চরম জায়গায় চলে গেছে।”
কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, “ধর্মান্ধ, ভূমিদস্যু ও সেটেলারদের দ্বারা আদিবাসীদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে তিনটি সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। এসব হামলায় আদিবাসীদের বাড়িঘর ও সম্পত্তির ভাঙচুর, লুটপাট ও ক্ষতিসাধন করা হয়।”
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধা জেলায় আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে আদিবাসী সাঁওতালদের কমপক্ষে দু শ’ বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাই সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার ভিডিও চিত্র প্রকাশিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আদিবাসী মানবাধিকার রক্ষা কর্মী ও আদিবাসী সংগঠনের সদস্যদের ওপর দমন, নিপীড়ন, নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। নির্বিচারে গ্রেপ্তার, আটক এবং হুমকিও অব্যাহত রয়েছে।
এক বছরে ১৭ আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার
কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশজুড়ে ১৭ জন আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ছয়জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। দলগত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন নয়জন। এ ছাড়া অন্তত ৫৩ জন আদিবাসী নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতিতদের মধ্যে ২৮ জন পার্বত্য চট্টগ্রামের ও ২৫ জন সমতলের।
তবে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে আদিবাসী নারীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কিছুটা কম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৫ সালে আদিবাসীদের ওপর ৮৫টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার মধ্যে ৬৯টিই ঘটেছিল নারীদের ওপর।
তবে ভূমির কারণে হত্যা এবং সহায়সম্পত্তি দখলের ঘটনা ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বেশি।
“ভূমির কারণে ঘরবাড়ি পোড়ানো, নারী নির্যাতন, লুটপাট, মিথ্যা মামলার সংখ্যাও বেড়েছে,” বলেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং।
২০১৬ সালে অন্তত ১৯১ জন আদিবাসী মানবাধিকার কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে সমতলের ৪২ জন নিরীহ আদিবাসী গ্রামবাসী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জন জনপ্রতিনিধিসহ ৮০ জন আদিবাসী মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অন্তত ৯৯ জন আদিবাসী শারীরিকভাবে নির্যাতন এবং হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং তল্লাশি অভিযানের নামে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দ্বারা একটি বৌদ্ধ বিহারসহ ২৯৭ টি বাড়িঘর তল্লাশি ও তছনছ করা হয়।
প্রতিবেদনটির সম্পাদক ও কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বেনারকে বলেন, “বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। কাপেং ফাউন্ডেশনের কর্মীরা এসব খবরের সত্যতা যাচাই করেছে।”