ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করায় দুই শিক্ষকের জেল
2016.04.28
মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে দেশে–বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্ক চলার মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা বাগেরহাটের একটি বিদ্যালয়ের হিন্দু ধর্মাবলম্বী দুই শিক্ষককে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। মুসলমান ছাত্রদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে তাঁদের তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গত ২৪এপ্রিল দুপুরে হিন্দু অধ্যুষিত চিতলমারী উপজেলায় এই ঘটনা ঘটে। উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক মো. আনোয়ার পারভেজ এই দণ্ড দেন। তবে বাংলাদেশের মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোতে এ বিষয়ে খবর প্রকাশ হয়নি। ছোটখাটো কিছু অনলাইন গণমাধ্যম ও পত্রিকায় এই খবরটি প্রকাশ হয়েছে।
বাগেরহাট প্রেসক্লাবের একাধিক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁরা এ বিষয়ে খবর সংগ্রহ করে তা প্রকাশের জন্য ঢাকায় নিজ নিজ গণমাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো খবরটি প্রকাশ বা প্রচার করেনি। তাঁদের ধারণা, ইসলাম ধর্মের অবমাননা বা হিন্দু শিক্ষকদের সাজা দেওয়ার ঘটনাগুলো দেশের অন্যত্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ।
অবশ্য বিবিসি বাংলা, ভয়েস অব আমেরিকা, এএফপিসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম খবরটি প্রকাশ করে।
চলতি এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রকাশিত দুটি পৃথক প্রতিবেদনে দেশটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। যদিও এসব প্রতিবেদনের জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশটিতে মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। তবে ধর্ম সম্পর্কে বিতর্কিত ও আপত্তিকর মন্তব্যের বিষয়ে সরকার কাউকে ছাড় দেবে না।
চিতলমারীতে দণ্ড পাওয়া দুই শিক্ষক হলেন, স্থানীয় হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী (৪৬) ও বিজ্ঞান শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষাল (৫৫)।
“২৪ এপ্রিল হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিএসসি শিক্ষক অশোক কুমার দশম শ্রেণির বিজ্ঞান ক্লাস চলাকালে হজরত মুহাম্মদ (স:) কে নিয়ে কটূক্তি করেন। পরে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা বিষয়টি অভিভাবকদের জানালে তারা স্কুলে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। ঘটনাটি প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদকে জানানো হলে তিনিও বিজ্ঞান শিক্ষকের পক্ষ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন,” বেনারকে জানান চিতলমারী উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক মো. আনোয়ার পারভেজ।
ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, “২৪ এপ্রিল বিকেলে ঘটনা জানতে পেরে সেখানে গিয়ে তাদের উদ্ধার করা হয়। পরদিন দুপুরে ওই স্কুলের সাত শিক্ষার্থীর সাক্ষ্য নেওয়া হলে তাঁরা ঘটনার বর্ণনা দেয়। স্কুলের ওই দুই শিক্ষকও তাদের দোষ স্বীকার করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে দণ্ডবিধি ১৮৬০ সালের ২৯৮ ধারায় প্রত্যেককে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।”
তবে প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলীর স্ত্রী উজ্জলা রানি দাশ গত বুধবার বিবিসি বাংলাকে জানান, “স্কুলের সভাপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটতে পারে বলে তার ধারণা। তিনি এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন।”
স্থানীয় পুলিশ জানায়, তাঁরা বিক্ষুব্ধ অভিভাবকদের হাত থেকে ওই দুই শিক্ষককে উদ্ধার করেছেন।
আইনানুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট,” বেনারকে জানান চিতলমারী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. রবিউল ইসলাম।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের স্থানীয় নেতা এবং বাগেরহাটের আইনজীবী মিলন ব্যানার্জি বেনারকে বলেন, “ঘটনাটি দুঃখজনক। এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।”
চিতলমারী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান অশোক বড়াল বেনারকে বলেন, “ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যা ঘটেছে তার চেয়ে বাড়াবাড়ি একটু বেশি হয়েছে।”
একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ঘটনার সপ্তাহখানেক আগে ক্লাসের সময় ছাত্ররা নামাজ পড়তে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রধান শিক্ষক প্রথমে তাদের নামাজে যেতে আপত্তি করেন। কিন্তু পরে আবার তাদের ক্লাস বন্ধ রেখে নামাজে যেতে বলেন। নামাজ শেষে ফেরার পর প্রধান শিক্ষক বলেন, নামাজিরা সব ফিরেছে কিনা? এ প্রসঙ্গে কয়েকজন ছাত্রের মন্তব্য হচ্ছে, প্রধান শিক্ষক নামাজ পড়া নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন।
সরকার দলীয় ওই স্থানীয় নেতা বলেন, সপ্তাহখানেক আগের এই ঘটনা কয়েকদিন ধরে ঘুরপাক খেয়েছে। এরপর তা ছোট থেকে বড় হয়েছে। তবে ম্যাজিস্ট্রেট হয়তো সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই সাজা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ২০ এপ্রিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বলছে, ‘সংবিধান কিংবা রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম নিয়ে সমালোচনা করা বাংলাদেশে একটি অশুভ চিন্তা।’
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘যেসব সাংবাদিক ও ব্লগার ইসলাম ধর্ম বা সংবিধান সম্পর্কে নিজেদের স্ব–আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকাতে পারেন না, তারা যাবজ্জীবন কিংবা মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি তৈরি করেন।’