ইরানে মানবাধিকার লঙ্ঘনে গঠিত জাতিসংঘ কমিটির প্রধান বাংলাদেশের সারা হোসেন

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.12.21
ঢাকা
ইরানে মানবাধিকার লঙ্ঘনে গঠিত জাতিসংঘ কমিটির প্রধান বাংলাদেশের সারা হোসেন ঢাকা হাই কোর্টে আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের জামিন আবেদন শুনানি শেষে তাঁর পরিবার সদস্যদের সাথে কথা বলছেন আইনজীবী সারা হোসেন (মাঝখানে) ২৯ অক্টোবর ২০১৮।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ঠেকাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো উদঘাটনে গঠিত জাতিসংঘ কমিটির প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন, যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের মেয়ে।

মঙ্গলবার জেনেভা থেকে এক বিবৃতির মাধ্যমে ব্যারিস্টার সারা হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের কথা জানায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন; পাকিস্তানের শাহিন সরদার আলী ও আর্জেন্টিনার ভিভিয়ানা ক্রিস্টিসেভিচ।

কূটনীতিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সারা হোসেনই প্রথম, যিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের কোনো সত্য উদঘাটন কমিটির প্রধান নিযুক্ত হলেন।

এই নিয়োগ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে বলে তাঁরা মনে করেন।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বুধবার বেনারকে বলেন, “আমি যতটুকু জানি সারা হোসেন ছাড়া কোনো বাংলাদেশি জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রধান হিসাবে নিয়োগ পাননি।”

সারা হোসেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী জানিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বুধবার বেনারকে বলেন, “সারা হোসেন তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে ইরানে মাশা আমিনির মৃত্যুর পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সঠিকভাবে উদঘাটন করবেন এবং উনি এটা পারবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।”

কাজটি অনেক চ্যালেঞ্জিং

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বুধবার বেনারকে বলেন, ব্যারিস্টার সারা হোসেনের নিয়োগ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে।

তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইরান একটি খুব স্পর্শকাতর বিষয়। সেখানে মাশা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারা দেশ ফুঁসে উঠেছিল। সেখানে নির্দয়ভাবে শত শত নারী-পুরুষকে হত্যা করেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। এতে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।”

নূর খান বলেন, “নির্দয়ভাবে সরকার সেই বিক্ষোভ, প্রতিবাদ দমন করলেও সরকারের নৈতিক পতন হয়েছে। সেখানকার নৈতিক পুলিশ ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “এমন একটি স্পর্শকাতর ও জটিল বিষয় তদন্তে গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনে সারা হোসেনকে নিয়োগ করা হয়েছে। কাজটি অনেক চ্যালেঞ্জিং।”

তবে আমি আশা রাখি উনি এই কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করে সেখানে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরবেন,” বলেন নূর খান।

সারা হোসেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। তিনি মূলত সংবিধান, জনস্বার্থ, পারিবারিক এবং মানবাধিকার আইনে বিশেষজ্ঞ।

তিনি মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক।

২০১৬ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে আন্তর্জাতিক সাহসী নারী পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি।

ওই বছরই সারা হোসেনকে উত্তর কোরিয়ার বিশেষ দূতকে সহায়তার জন্য নিয়োগ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার।

২০১৭ সাল থেকে নির্যাতন শিকার ব্যক্তিদের জন্য জাতিসংঘের গঠিত বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য হিসাবে কাজ করছেন তিনি।

২০১৮ সালের আগস্টে বাংলাদেশের আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা বহুল আলোচিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মামলায় তাঁর পক্ষের আইনজীবী ছিলেন সারা হোসেন।

সারা হোসেনের স্বামী ব্রিটিশ নাগরিক ও সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, তাঁর বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে লেখালেখি করেন বার্গম্যান, যা বাংলাদেশ সরকার অপপ্রচার আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ করে আসছে।

সারা হোসেনের বাবা ড. কামাল হোসেন ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে গণফোরাম নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গঠন করেন। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ছিলেন সরকারবিরোধী জোটের প্রধান নেতা।

কী হয়েছিল ইরানে?

ইরানের সাম্প্রতিক বিক্ষোভের শুরু ১৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যালঘু কুর্দি ইরানী নারী মাশা আমিনির (২২) বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া সম্প্রদায়ের দেশ ইরানের সাড়ে ৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ সংখ্যালঘু কুর্দি নাগরিক, যাদের অধিকাংশই সুন্নি মুসলমান।

কট্টর শিয়া আদর্শের অনুসারী সরকারের নিয়মানুযায়ী নয় বছরের বেশি সব নারীকে তাদের চুল ঢেকে রাখতে হয় এবং হিজাব পরতে হয়ে। নারীরা এই নিয়ম পালন করছেন কি না, সেটি দেখতে নৈতিক পুলিশ রয়েছে।

চুল ঢেকে না রাখা এবং হিজাব পরিধান সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘন করার অপরাধে ইরানের নৈতিক পুলিশ মাশা আমিনিকে আটক করে। তিন দিন অচেতন থাকার পর পুলিশি হেফাজতে তাঁর মৃত্যু হয়।

মাশা আমিনির পিতা-মাতার দাবি, নৈতিক পুলিশের নির্যাতনেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

এই ঘটনা জানাজানি হলে ইরানের প্রায় ৮০টি শহর বিক্ষোভে অচল হয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে নেতৃত্বে দেন ইরানের নারীরা। অনেক নারী প্রতিবাদ করতে জনসমক্ষে চুল কেটে ফেলেন।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আন্দোলন দমাতে সরকারি বাহিনী চরম নিষ্ঠুরতা দেখায়। গুলি করে হত্যা করা হয় শতাধিক নারী এবং শতাধিক পুরুষকে। কয়েকজন আন্দোলনকারীকে ক্রেনে ঝুলিয়ে প্রকাশ্যে ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, এই ঘটনার প্রতিবাদে কাতারে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপে জাতীয় সঙ্গীত গাননি সেদেশের ফুটবলাররা। বেশ কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং ফুটবলারকে আটক করেছে ইরানের পুলিশ।

তবে এই আন্দোলনের ফলে নৈতিক পুলিশ বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয় ইরান সরকার।

সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, সরকার বিরোধী এই আন্দোলনে বিদেশি সহায়তা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ গোলমালের জন্য ইরান বরাবর ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে দায়ী করে থাকে।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ অস্বীকার করা হয়ে থাকে।

১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই ইরানের।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।