দুর্বৃত্তদের গুলিতে পাহাড়ে চার ইউপিডিএফ নেতা নিহত

আহম্মদ ফয়েজ
2023.12.12
ঢাকা
দুর্বৃত্তদের গুলিতে পাহাড়ে চার  ইউপিডিএফ নেতা নিহত খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির প্রত্যন্ত গ্রামে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) চার নেতাকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিক্ষোভ মিছিল করে। ১২ ডিসেম্বর ২০২৩
জীবন আহমেদ

বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির একটি প্রত্যন্ত গ্রামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) চার নেতাকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।

এই ঘটনার সময় সংগঠনের তিনজন নেতা-কর্মীকে অপহরণ করা হয়।  প্রায় ২৪ ঘন্টা পরও তাদের সন্ধান মেলেনি।

সোমবার রাতে পানছড়ির লোগাঙয়ের অনিল পাড়া গ্রামে এই হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের কথা নিশ্চিত করে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বেনারকে বলেন, এই ঘটনায় পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।  তবে কাউকে আটক করা যায়নি।

নিহতরা হলেন; ইউপিডিএফ সমর্থিত গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল চাকমা (৩২), পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ—সভাপতি সুনীল ত্রিপুরা (২৮), গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহ—সভাপতি লিটন চাকমা (২৯) এবং ইউপিডিএফ সংগঠক রহিন বিকাশ ত্রিপুরা (৪৯)।

পুলিশ জানায়, দুর্গম এলাকা হওয়ায় ঘটনার ১৯ ঘন্টা পর মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এ ছাড়া সংগঠনের তিন নেতা-কর্মী হরি কমল ত্রিপুরা, নীতি দত্ত চাকমা, প্রকাশ ত্রিপুরাকে অপহরণ করা হয়েছে।

ইউপিডিএফের জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা বেনারকে বলেন, “নিহত চারজনসহ সাতজন মঙ্গলবার সেখানে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের উদ্যোগে অনুষ্ঠিতব্য যুব সম্মেলন যোগ দেয়ার কথা ছিল।  সম্মেলনে যোগ দিতে তারা সেখানে অবস্থান করছিলেন। ”

রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে পানছড়ি সদর এলাকা থেকে ''নব্যমুখোশ'' দুর্বৃত্তদের একটি সশস্ত্র দল ওই বাড়িতে ঢুকে ঠান্ডা মাথায় একে একে চারজনকে গুলি করে হত্যা করে বলে জানান তিনি।

নব্যমুখোশ বলতে ইউপিডিএফ তাদের একটি বিদ্রোহী গ্রুপ—গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফকে বুঝায়।

জানতে চাইলে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের সভাপতি শ্যামল চাকমা বেনারকে বলেন, “এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।  আমরা কোনো অস্ত্রের রাজনীতি করিনা। এখানে অনেক সংগঠন আছে, আমাদের বিরুদ্ধে এভাবে অভিযোগ তোলা খুবই অনুচিত।”

মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কেউ এই বন্দুক হামলার দায় স্বীকার করেনি।

এদিকে ইউপিডিএফ ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে অবরোধ ও বয়কটসহ বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি এবং ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ভেঙে দেয়ার দাবিতে ইউপিডিএফ ও সহযোগী সংগঠনগুলো আগামী ১৩ থেকে ১৫ ডিসেম্বর প্রতিবাদ সমাবেশ, শোক সভা ও বিভিন্ন স্থানে কালো পতাকা উত্তোলন করবে।

১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত পানছড়ি বাজার বয়কট করা হবে এবং প্রয়োজনে বয়কটের মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে।

এতে বলা হয়, ১৭ ডিসেম্বর পানছড়ি উপজেলাব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট এবং ১৮ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি জেলাব্যাপী সকাল—সন্ধ্যা শান্তিপূর্ণ সড়ক অবরোধ করা হবে।

অপরদিকে, চার ইউপিডিএফ নেতাকে হত্যা ও তিন সংগঠককে অপহরণের প্রতিবাদে মঙ্গলবার ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম (ডিওয়াইএফ)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলটি ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র থেকে শুরু করে অপরাজেয় বাংলা, মধুর ক্যান্টিন হয়ে রাজু ভাস্কর্যে এসে এক প্রতিবাদ সমাবেশে মিলিত হয়।

সমাবেশে বক্তারা, ‘রাষ্ট্রীয় বাহিনীর’ মদদে পানছড়ি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। অবিলম্বে তারা পানছড়ি হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে ঘটনার সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

প্রতিষ্ঠার পর তিন শতাধিক নেতাকর্মী খুন

পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৯৮ সালে গড়ে ওঠার পর থেকে পাহাড়ের বিভিন্ন অস্ত্রধারি গ্রুপ ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে তিন শতাধিক ইউপিডিএফ নেতাকর্মী নিহত হয়েছে। বেনারকে এই তথ্য জানান ইউপিডিএফের সংগঠক অংগ্য মারমা।

তিনি বলেন, কিছুদিন পরপরই এক বা একাধিক ইউপিডিএফ কর্মী হত্যার শিকার হচ্ছে।

বড় কোনও ঘটনা না ঘটলে সেগুলো খুব একটা আলোচনায় আসে না দাবি করে তিনি বলেন, সর্বশেষ ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে বন্দুকধারীদের গুলিতে তিন ইউপিডিএফ কর্মীসহ সাতজন খুন হয়েছিলেন।

“এই ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলো।  কিন্তু গত জানুয়ারি, এপ্রিল এবং মে  মাসেও একজন করে ইউপিডিএফ কর্মী খুন হন।  সেগুলো খুব একটা আলোচনায় আসেনি,” বলেন তিনি।

অংগ্য মারমার অভিযোগ, পাহাড়ে শান্তি চায় না এমন গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে ২০১৮ সালে গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ নামের সংগঠনটি।

“এই সংগঠনের জন্মের পর থেকে হত্যাকাণ্ড বাড়তে থাকে,” দাবি অংগ্য মারমার।

এই অভিযোগ সম্পর্কে শ্যামল চাকমা বলেন, “আমরা কখনো হত্যার রাজনীতি করিনি, করবও না। আমাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সত্য নয়।”

‘পাহাড়ে শান্তি নষ্টে সক্রিয় কিছু মানুষ’

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং পাহাড়ে ইচ্ছাকৃত অশান্তি চায় এমন কিছু ব্যক্তি এসব হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার পেছনে দায়ী বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ও শিক্ষাবিদ নিরূপা দেওয়ান।

“পাহাড়ে শান্তি নষ্টে সক্রিয় কিছু মানুষ। তারা পাহাড়ের হতাশাগ্রস্ত যুবকদের কাজে লাগিয়ে একের পর এক সহিংসতা ঘটিয়ে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।

পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করা এই মানবাধিকারকর্মী মনে করেন, সাধারণ জনপদের তুলনায় পাহাড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশী জোরদার থাকার পরও একের পর এক সহিংসতা সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে  শান্তি চুক্তি সই হয়েছিল।  তবে দীর্ঘ সময়েও চুক্তির বেশির ভাগ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন পাহাড়ের নেতারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।