রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধে ইসির সিদ্ধান্ত সরকারেরই পরিকল্পনা: বিশেষজ্ঞ

অয়ন আমান
2023.12.13
ঢাকা
রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধে ইসির সিদ্ধান্ত সরকারেরই পরিকল্পনা: বিশেষজ্ঞ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপি সমর্থক এবং আইনজীবিদের প্রতিবাদ সমাবেশ। ডিসেম্বর ১০, ২০২৩।
এএফপি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন—তা সংবিধান পরিপন্থি বলে মনে করছেন আইনজীবী ও রাজনীতিকরা।

তাদের শঙ্কা, এমন সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতাকে আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

বিরোধীদের অভিযোগ, সরকার পতনের আন্দোলন পণ্ড করতে সরকারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই এই সিদ্ধান্ত এসেছে।

বুধবার এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আইনি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানবাধিকারকর্মী ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেনারকে বলেন, “এটা আমাদের সংবিধানের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অনেক কিছুই করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে। কিন্তু এমন কিছু করার ক্ষমতা নেই, যা মানুষের সংবিধান স্বীকৃত অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।

“এটা অবশ্যই সংবিধান স্বীকৃত অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক,” বলেন তিনি।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, “কী বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন এই ধরনের চিঠি দিয়েছেন তা আমরা জানি না। আমার ধারণা, যেহেতু একটি পক্ষ নির্বাচন চাচ্ছে, আরেকটি পক্ষ বলছে এই নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু হবে না এবং কর্মসূচি দিচ্ছে সেহেতু বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কর্মসূচি নিষিদ্ধ করতেই তারা (নির্বাচন কমিশন) এই নির্দেশনা দিয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “এ রকম নির্দেশনা আমার বিবেচনায় একেবারেই অবৈধ এবং এগুলো নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতাকে আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করবে।”

প্রায় একই মত দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি বেনারকে বলেন, “প্রত্যেকটা নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার যেমন আছে, একইভাবে না দেওয়ারও অধিকার আছে। ভোট দেওয়ার পক্ষে প্রচার করতে পারা যেমন অধিকার, না দেওয়ার‌‌‌ পক্ষে প্রচার করতে পারাও অধিকার। কোনো ক্রমেই এ ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ করার অধিকার কারও নেই।

“এটা নির্বাচন কমিশনের কেবলমাত্র অন্যায্য-অনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়। এটা আমাদের সংবিধানের মৌলিক বিধানের পরিপন্থি। ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা একাত্তর সালেই এই ব্যবস্থা পাকাপাকি করে ফেলেছি যে, মানুষের মিছিল করার, মিটিং করার, সমাবেশ করার অধিকার থাকবে।”

তবে কমিশনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তিনি বেনারকে বলেন, “নির্বাচনকালে কমিশনের অনেক ক্ষমতা আছে। সংবিধানের কোনো ধারাকে একটা বিশেষ সময়ের প্রয়োজনে যদি তারা মনে করে প্রযোজ্য না; সেটা তারা পারে কি না আমি বলতে পারবো না। তবে এটার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না।”

তিনি বলেন, “তারা (নির্বাচন কমিশন) একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এমনটা চাচ্ছেন। যেহেতু বিরোধী দল নির্বাচনে আসেনি, এই সময়ে কমিশন মিছিল-সমাবেশ বিরত রাখতে চায়—নির্বাচনী পরিবেশ বজায় রাখার জন্য।

 এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, “নির্বাচন কমিশন তো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তারা যখন একটি নির্দেশনা দিয়েছেন, তারা তো সংবিধান দেখেই দিয়েছেন। এখানে সংবিধান লঙ্ঘন হওয়ার কিছু নেই, এখানে তো নির্বাচন কীভাবে হবে সেটা তারা জানেন।”

 তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন দমাতে সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান।

তিনি বেনারকে বলেন, “নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন কোনো সত্তা নেই। কমিশনের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এটা জারি করা হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, এটা করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এরা আমাদের আন্দোলন দেখছে।”

গত ১৩ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের পরিচালনা শাখার উপসচিব আতিয়ার রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে একটি চিঠি পাঠান।

তাতে বিষয় হিসেবে উল্লেখ ছিল, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন পূর্ব সময়ে রাজনৈতিক দলের কোনো সভা, সমাবেশ বা অন্য কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচি আয়োজনের অনুমতি প্রদান না করা প্রসঙ্গে’।

চিঠিতে বলা হয়, আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ১৮ ডিসেম্বর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণা শুরু করবেন। সেই সময় থেকে ভোটগ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ছাড়া কোনো প্রকার সভা-সমাবেশ বা রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা থেকে সবাইকে বিরত রাখা বাঞ্ছনীয়—যাতে নির্বাচনী কাজ বাধাগ্রস্ত বা ভোটাররা ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত না হন।

 বুধবার এই চিঠির ব্যাখ্যা দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচনে কেউ যদি বাধা দেয় অথবা কেউ যদি প্রতিহত করে, সেটা আমাদের আইন অনুযায়ী অপরাধ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।

“নির্বাচন বাধাগ্রস্ত না হলে কোনো সভা-সমাবেশে আমাদের কোনো আপত্তি নেই,” বলেন তিনি।

উল্লেখ্য, গত ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করার উদ্যোগ নিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ৫ ডিসেম্বর দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, বাইরে সমাবেশের নামে শোডাউন হবে আশঙ্কায় কমিশন অনুমতি দেয়নি।

সে কারণে সমাবেশের বদলে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করে ক্ষমতাসীন দল।

তবে সংঘর্ষ ও পুলিশি বাধার মুখে সারা দেশে জেলা শহরগুলো মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে বিএনপি।

হবিগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ ও ফরিদপুরসহ বিএনপি জায়গায় পুলিশি বাধায় শুরুতেই পণ্ড হয়ে যায় মানববন্ধন। গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা করে পুলিশ।

আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় র‍্যালি করার অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। বুধবার বিকেলে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ডিএমপি সদর দপ্তরে গিয়ে এ সংক্রান্ত চিঠি দেন।

অন্যদিকে বিজয় দিবস উপলক্ষে আগামী ১৮ ডিসেম্বর র‍্যালি করার অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি দিয়েছে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।