হাসপাতালের বিপজ্জনক তরল বর্জ্য বিশুদ্ধ পানিতে রূপান্তর

কামরান রেজা চৌধুরী
2025.03.10
ঢাকা
হাসপাতালের বিপজ্জনক তরল বর্জ্য বিশুদ্ধ পানিতে রূপান্তর ঢাকার উত্তরায় কুয়েত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের একটি আধুনিক বর্জ্য শোধনাগারে চিকিৎসা বর্জ্য থেকে পরিশোধিত পানি সংগ্রহ করছেন একজন কর্মী । ৫ মার্চ ২০২৫।
কামরান রেজা চৌধুরী/ বেনারনিউজ

প্রথম সরকারি হাসপাতাল হিসেবে উৎপাদিত তরল বর্জ্য শতভাগ বিশুদ্ধ পানিতে রূপান্তর করছে ঢাকার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বেনারকে জানান, দৈনিক ২৪ হাজার লিটার তরল বর্জ্য পরিশোধনযোগ্য একটি অত্যাধুনিক পরিশোধনাগার গত ফেব্রুয়ারিতে চালু হয়েছে।  পরিশোধিত এই পানি বাগান পরিচর্যায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

বর্তমানে হাসপাতালটি প্রতিদিন ১৫ হাজার লিটার মলমূত্র এবং জীবাণু বহনকারী তরল পদার্থ পরিশোধন করছে বলে জানান তিনি।

এই প্রকলপ বাস্তবায়নে হাসপাতালটিকে সহায়তা করছে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর তরল বর্জ্য সাধারণত নর্দমা, খাল, নদী ও অন্যান্য জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়।  এগুলো পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্নক ঝুঁকি।”

“কিছু হাসপাতাল প্রথাগত সেপটিক ট্যাংক নির্মাণ করে তরল বর্জ্য পরিশোধন করে। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন জীবাণু রয়ে যায়,” বলেন তিনি।

অধ্যাপক তানভীর বলেন, “সরকারি আইন অনুযায়ী, প্রায় সকল হাসপাতালে তরল বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।  অন্যথায় সেই হাসপাতাল পরিবেশ ছাড়পত্র পাবে না।  কিন্তু বাংলাদেশে এই নিয়ম মানা হয় না।  তবে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে যে ব্যবস্থা চালু হয়েছে সেটি অন্যান্য হাসপাতালে স্থাপন করা গেলে সকলের জন্যই ভালো হবে।”

প্রথাগত উপায়ে তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আইসিডিডিআর,বি’র সহযোগী গবেষক ড. মো. নুহু আমিন বেনারকে বলেন, "প্রথাগত সেপটিক ট্যাঙ্কের মাধ্যমে তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রথমে তরল বর্জ্য একটি চেম্বারে নেওয়া হয়। যেখানে কঠিন বর্জ্য তলানিতে জমা হয়। এরপর পানি পার্শ্ববর্তী চেম্বারে চলে যায়।”

“সেপটিক ট্যাঙ্কে অক্সিজেনের অভাবে কিছু ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু অনেক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও প্যাথজেনগুলো মারা যায় না। সেগুলো পরে পরিবেশে চলে যায়।” ব্যাখ্যা করেন তিনি।

নুহু আমিন বলেন, “আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, পানি শতভাগ বিশুদ্ধ।  এই পানি গাড়ি ধোয়া, টয়লেট ফ্ল্যাশ, মেঝে পরিষ্কার ও বাগান পরিচর্চায় ব্যবহার করার সুপারিশ করেছি। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ওই পানি দিয়ে বাগান করা হয়েছে।”

উল্লেখ্য, দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও তরল বর্জ্য পরিশোধন করা হয় না।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার মো. আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “এই হাসপাতালে তরল বর্জ্য আলাদা করার কোনও ব্যবস্থা নেই।   এগুলো সিটি কর্পোরেশনের নর্দমার মাধ্যমে চলে যায়।”

“এই হাসপাতালের বয়স ১৩০ বছরের বেশি।  হাসপাতালের নতুন ভবন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে তরল ও কঠিন বর্জ্য পরিবেশসম্মতভাবে পরিশোধন করার ব্যবস্থা থাকবে,” বলেন তিনি।

তরল বর্জ্য যেভাবে শোধন হয়

ড. মো. নুহু আমিন অত্যাধুনিক এই শোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। আইসিডিডিআর,বি’র সাথে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অব সিডনি।  স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেতৃত্বে এই প্রকল্পে আরও কাজ করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতীয় একটি কোম্পানি এর বাণিজ্যিক বিষয়টি দেখবে।

নুহু আমিন বলেন, বাংলাদেশে প্রতিদিন কত পরিমাণ মেডিকেল তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয় তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই, গবেষণাও নেই।
তিনি বলেন, ২৫০ শয্যার কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার লিটার বিপজ্জনক তরল হাসপাতাল বর্জ্য উৎপাদন হয়।  অন্যদিকে স্থাপিত শোধনাগারের ক্ষমতা দৈনিক ২৪ হাজার লিটার।

ব্যাকটেরিয়া, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী মাইক্রোঅরগানিজম (এএমআর), ভাইরাস এবং প্যারাসাইট—এই চার ধরনের বিপজ্জনক উপাদান হাসপাতালের তরল বর্জ্যে উপস্থিত থাকে বলে জানান তিনি।

নুহু আমিন বলেন, এই শোধনাগারে মূলত রাসায়নিক পদার্থ ছাড়াই পাঁচ স্তরে পানি শোধন করা হয় এবং পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ছয় ঘন্টা সময় লাগে।  

পানি থেকে আলাদা করা জীবাণু এ.এম.আর ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য অধ:ক্ষেপ সদৃশ বস্তকে আলাদা করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়।

কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের উদ্ভাবন বাংলাদেশে হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।  তবে এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশে অন্য হাসপাতালগুলোতে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে, ঢাকা শহরে মোট ৩৩টি হাসপাতাল রয়েছে।  পর্যায়ক্রমে সব হাসপাতালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চেষ্টা করা হবে।

এই ধরনের শোধনাগার স্থাপন করতে এক কোটি টাকার কম খরচ হবে বলেও জানান নুহু আমিন।

ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আইসিডিডিআর,বি আগ্রহী হলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমরাও তরল বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা স্থাপন করতে চাই।”

পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং শাখার উপপরিচালক কবির আহমেদ খান বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-২০২৩ অনুসারে ২০ শয্যার বেশি হাসপাতালে তরল বর্জ্য শোধনাগার থাকতে হবে।  অন্যথায় পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হবে না।  কিন্তু এখন পর্যন্ত হাতে গোণা দুই-একটি ছাড়া কোন হাসপাতালেই সেই ব্যবস্থা নেই।

বুয়েটের অধ্যাপক তানভীর আহমেদ বেনারকে বলেন, “ঢাকাসহ দেশের হাসপাতালগুলোর ড্রেনেজ ব্যবস্থা অপরিকল্পিত হওয়ায় তরল বর্জ্য এক জায়গায় করার ব্যবস্থা নেই।  সেটি করতে হলে আগে বিদ্যমান ড্রেনেজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। ”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।