তিব্বতকে ঘিরে বাড়ছে চীনের জলবিদ্যুৎ শিল্পের তৎপরতা

স্টিফেন রাইট,আরএফএ
2025.01.09
ব্যাংকক
তিব্বতকে ঘিরে বাড়ছে চীনের জলবিদ্যুৎ শিল্পের তৎপরতা চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বতের নিংচি শহরের ইয়ারলু জাংবোর গিরিখাতের দৃশ্য।মার্চ ২৮। ২০২১। ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

তিব্বতকে ঘিরে চায়নার ক্রমবর্ধমান জলবিদ্যুৎ শিল্পের তৎপরতা বাড়ছে। এর ফলে এ অঞ্চলে যেটিকে চীন তার শিল্পোন্নত পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস হিসেবে দেখে আসছে , সেখানে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি ও অস্থিতিশীলতা তৈরী হতে পারে বলে তিব্বতের অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ও গবেষকরা মনে করছেন।

চীন গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শিল্পায়নের গতি বাড়াতে অনেক নদীর জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে, নির্মাণ করেছে বৃহৎ ২২,০০০ হাজার বাঁধ যা পৃথিবীর মোট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে দেয়া বাঁধের ৪০ শতাংশ। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ছিল তিব্বতের মালভূমি।

ভৌগলিক অবস্থানের কারনে পৃথিবীর ছাদ নামে পরিচিত তিব্বত অঞ্চল এশিয়ার বৃহৎ নদী ও হিমালয়ের হিমবাহের শুধু উৎসস্থল নয়, এটি কোটি কোটি মানুষের সুপেয় পানির উৎসও।  গত শতকের মাঝামাঝিতে চীন তিব্বত আক্রমণ করে মূল ভূখন্ডের সাথে এটিকে একীভূত করে নেয়।

সরকারি উপাত্তের বরাতে একজন গবেষক জানাচ্ছেন, এ মালভূমির ১১০ গিগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে যা চীনের পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিতে গতি আনতে পারে। এক গিগাওয়াট বিদ্যুৎ দিয়ে দশ কোটি বাতি জ্বালানো যায়।

২০১৩ সালে একাডেমিক তাশি সেরিং তিব্বতে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে বা বাঁধ নির্মাণ প্রস্তাব করা হয়েছে এমন ১১৩ টি বাঁধের তালিকা তৈরী করেন। তিব্বতের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে সোচ্চার থাকা ওয়াশিংটন ভিত্তিক সংগঠন “ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর তিব্বত” এর করা এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে এক দশক পরে তিব্বতে নির্মিত অথবা প্রস্তাবিত বাঁধের সংখ্যা এখন ১৯৩ টি।

বৈশ্বিকভাবে জলবিদ্যুৎ শিল্পের উদ্যোক্তারা বাঁধ দিয়ে তৈরী জলবিদ্যুৎকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে প্রচারণা চালান যেখানে  সৌর ও বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার মুখে পড়তে হয় না। এসব বাঁধ নির্মাণের ফলে বাঁধের উদ্যোক্তা ও পরিচালকেরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হলেও এর ফলে বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায় হাজার হাজার মানুষ। ক্ষতিগ্রস্থ হয় মৎস্যসম্পদ । নদীবাহিত পলি থেকে বঞ্চিত হয়ে অববাহিকায় থাকা কৃষিজমিগুলো উর্বরতা হারায়।

বৃহৎ নদীগুলোর গতিপথ পাল্টানোর চীনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এর মধ্যে অভ্যন্তরীন বিতর্কের মুখে পড়েছে। চীনের কিছু প্রকৌশলী এসব পরিকল্পনার সমালোচনা করেছেন। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সেটা ভারতের সাথে উত্তেজনা বাড়াবে। কারণ, এসব প্রকল্পে আন্তমহাদেশীয় নদীর পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর তিব্বত (আইসিটি) এর গবেষণায় রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব আছে বলে মনে করা হয়। কারণ এটি তিব্বতকে দখলকৃত তিব্বত বলে অভিহিত করে। পৃথিবীর কোন দেশ এখনো তিব্বতকে সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এ গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন গবেষকরা এ গবেষণার মান নিয়ে মিশ্র মতামত দিয়েছেন।

যথার্থ উদ্বেগ

গবেষণায় প্রাপ্ত উপাত্তকে দুজন গবেষক বলছেন বিশ্বাসযোগ্য। অন্যদিকে চীনের একজন জলবিদ্যুৎ গবেষক ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নির্ণয়ের পদ্ধতি ও কোনটা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, কোনটা পানি সরবরাহ প্রকল্প আর কোনটা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ- গবেষণাটি এসব পার্থক্য করতে পারেনি বলে সমালোচনা করেছেন।

তিনি বলেন, “এ গবেষণাটি পুরো হিমালয় অঞ্চলজুড়ে ভারত, নেপাল, ভূটানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জোর তৎপরতা চললেও চীনকে ঘিরেই তাদের গবেষণাটি নিবদ্ধ ছিল”। চীনে গবেষণা করার অনুমতি বাতিল হয়ে যেতে পারে আশংকায় এ গবেষক নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।

আইসিটি ভূ-উপগ্রহ থেকে নেয়া তথ্যের বিশ্লেষণ ও পাবলিককি সহজলভ্য তথ্যের ভিত্তিতে নির্মিত অথবা প্রস্তাবিত বাঁধের সংখ্যাটি পেয়েছে। এ গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে যদি সকল বাঁধ নির্মাণ করা হয় তাহলে সাড়ে সাত লাখ থেকে ১৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।

f0ccd0ca-aacc-4696-bd43-bc595f023fda.jpeg
চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বতের নিংচি শহরের ইয়ারলু জাংবোর গিরিখাতের দৃশ্য। মার্চ ২৮। ২০২১। ছবি: এএফপি

চীন তিব্বতে জলবিদ্যুৎ নিয়ে তাদের উচ্চাকাঙ্খার সম্পূর্ণ রুপরেখা স্পষ্ট করেনি। কারণ, এসব পরিকল্পনায় ভাটি অঞ্চলের দেশ, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও পরিবেশবীদরা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

আইসিটি বলছে এসব দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মানে হল এখনো এসব ধ্বংসাত্বক প্রকল্প পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে। এখনো ৬০ শতাংশ বাঁধের কাজ শুরু হয়নি।

তিব্বতের সিচুয়ান কাউন্টিতে ১১ হাজার মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নেয়া হয়েছে যেটির কারণে ছয়টি বৌদ্ধ মঠ পানির নিচে চলে যাওয়া আশংকা তৈরী হয়েছে। গত বছর সে বাঁধের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অভাবিত প্রতিবাদ হয়েছে এবং নতুন করে তিব্বতের চীনা শাসন নিয়ে বিশ্বের মনোযোগ পেয়েছে।

বার্লিনের ফ্রি ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব চায়না স্টাডির অধ্যাপক সাবরিনা হাবিচ সেবাগুল রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন, তিব্বতে সমস্যাপূর্ণ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। সক্ষমতা ও বাঁধের সংখ্যা বিচারে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এখন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। চীনের ইউনান ও সিচুয়ান প্রদেশেও এসব বাঁধ নির্মাণ এগিয়ে চলছে।

”এসব বাঁধ ভাটি অঞ্চলের অনেক পানিপ্রবাহকে ইতিমধ্যে শেষ করেছে এবং তা তিব্বত ও উজানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে”, বলেন তিনি।

আড়ালের স্বার্থ

ডিসেম্বরে চীনের রাষ্ট্রায়াত্ত বার্তা সংস্থা জিনহুয়ার বরাতে জানা গেছে চীন তিব্বতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। ইয়ারলুং সাংপো নদীর উপর প্রস্তাবিত এ মেডগ বাঁধটি চীনের থ্রি গর্জেস নামের পরিচিতি বৃহৎ বাঁধের তিনগুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। তবে, কবে নাগাদ এ নির্মাণ কাজ শুরু হবে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।

অধ্যাপক সেবাগুল বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভরতা কমানোর প্রচেষ্টা হিসেবে চীন এসব জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে নেমেছে। এসব লক্ষ্য অর্জনে প্রেসিডেন্ট শি জিং পিংয়ের সমর্থন আছে। তার মানে হলো চীনের কর্মকর্তারা এসব প্রকল্প কাগজে-কলমে তো বটেই, প্রায়োগিকভাবেও সেগুলো বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবেন।

ইউনিভার্সিটি অব কলারোডা বোল্ডারের ভূগোলের শিক্ষক ও তিব্বত গবেষক অধ্যাপক এমিলি ইয়ে বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা বা জলবায়ুর লক্ষ্য অর্জন ছাড়াও চীন সবসময় তার পশ্চিমাঞ্চলকে পূর্বাঞ্চলের জন্য কাঁচামালের রশদ হিসেবে দেখে এসেছে যেখানে জনসংখ্যা ও শিল্পায়ন কেন্দ্রিভূত হয়েছে।

বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, চ্যাটজিপিটি ও বহুল ব্যবহৃত ক্লাউড-কম্পিউটিং নির্ভরতা বিদ্যুতের চাহিদাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন তিনি।

ক্যালগেরি মাউন্ড রয়্যাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও গবেষক সেরিং বলেন, ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রভাব ও গভীর রাজনৈতিক সংযোগের কারনে চীনের জলবিদ্যুৎ শিল্প ও বাঁধ নির্মাণকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শিল্পের সাথে তুলনা করেন।

২০২৪ সালের এপ্রিলে তিনি এক সেমিনারে বলেছিলেন চায়না বাঁধ নির্মাতা রাষ্ট্রকে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে।

তিনি বলেন, “তিব্বতবাসী এখন এমন দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে যেটি তাদের প্রাচীন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরিবেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে যদি না তিব্বতবাসী ও চীনের নীতিনির্ধারকরা বিদ্যুতের মত তিব্বতের পরিবেশ ও ঐতিহ্য রক্ষায় একইরকম গুরুত্ব অনুধাবন না করেন”।

চীনের অধিকাংশ মানুষের কাছে এসব বাঁধ নির্মাণের কুশিলবদের স্বার্থ ও এসব বাঁধের পরিকল্পনা সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে পানির গতিপথ পাল্টানোর ও শত শত বাঁধের আধার হয়ে উঠবে তিব্বত।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।