নিজের আসনে হারলেও টানা তৃতীয়বারের মতো পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
2021.05.02
কলকাতা

প্রাথমিকভাবে জয়ী ধরে নিলেও চূড়ান্তভাবে দেখা গেলো নিজের আসনে হেরে গেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে তাঁর ব্যক্তিগত হারের পরও টানা তৃতীয়বারের মতো বিধানসভায় সরকার গঠন নিশ্চিত করেছে তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস।
পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার এই নির্বাচনে রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে কেন্দ্র সরকারে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ভবিষ্যদ্বাণী থাকলেও রোববারের ফলাফলে তৃণমূলের কাছে বিপুল ব্যবধানে হেরেছে বিজেপি।
মমতার নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র নন্দীগ্রামে প্রথম দিকে তাঁকে জয়ী হিসেবে প্রচার চললেও শেষ পর্যন্ত সেই আসনে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকে বিজয়ী ঘোষণা করে ভারতের নির্বাচন কমিশন।
এর আগে “যান্ত্রিক গোলযোগের” কারণে নন্দীগ্রামে প্রায় ঘণ্টাখানেক ভোটগণনা বন্ধ রাখা হয়, যার ভিত্তিতে সন্ধ্যায় ফেসবুকে সম্প্রচারিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভোটে কারচুপির অভিযোগ করেন মমতা।
তিনি জানান, এই ফলাফলের বিরুদ্ধে ভারতের সুপ্রিম কোর্টেও যেতে পারে তাঁর দল। তাঁর এই অভিযোগের জেরে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক আরিজ আফতাব সংবাদমাধ্যমকে জানান, রিটার্নিং অফিসার সুপারিশ করলে নন্দীগ্রামে পুনরায় ভোট গণনা হবে।
অবশেষে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর নন্দীগ্রামের রিটার্নিং অফিসার ঘোষণা করেন, নির্বাচনে শুভেন্দু পেয়েছেন এক লাখ ৯ হাজার ৬৭৩ ভোট। আর মমতা পেয়েছেন এক লাখ ৭ হাজার ৯৩৭ ভোট।
নিজের আসনে মমতার হেরে যাওয়া আগামী পাঁচ বছরের জন্য পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় তাঁর সরকার গঠনে কোনো বাধা নয়।
যেহেতু তৃণমূলে মমতাই মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী, সেহেতু ভারতের নির্বাচনী আইন অনুযায়ী আগামী ছয় মাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের যে কোনো একটি আসনে উপনির্বাচনে জিততে হবে তাঁকে।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতির ফলে নির্বাচন কর্মীর সংখ্যা কম হওয়ায় অন্যান্য বারের তুলনায় অনেকটাই ঢিমেতালে চলছে ভোট গণনা। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া শেষ তথ্য অনুযায়ী, বিধানসভার ২৯২ আসনের মধ্যে ১৪১টি আসনে জয়ী হয়েছে তৃণমূল, এগিয়ে রয়েছে ৭১ টি আসনে।
পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১৪৮টি আসন।
প্রার্থীদের মৃত্যুজনিত কারণে এর আগে দুটি আসনে ভোট মুলতুবি করা হয়েছে, যেগুলোতে চলতি মাসেই ভোট হওয়ার কথা।
অন্যদিকে ৪০টি আসন পেয়েছে বিজেপি, এগিয়ে রয়েছে ৩৮টি আসনে, যদিও এর আগে ২০১৬ সালের নির্বাচনে তারা পেয়েছিল মাত্র তিনটি আসন।
ভারতের আরও তিনটি রাজ্য - কেরালা, তামিলনাড়ু, এবং আসাম - ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচ্চেরিতেও নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয় আজ। তামিলনাড়ু এবং কেরালায় হারলেও আসামে এবং পুদুচ্চেরিতে জয় পেয়েছে বিজেপি ও তাদের জোটসঙ্গীরা।

হারের ফল বিজেপির জন্য ‘সুদূরপ্রসারী’ হতে পারে
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির হারের ফল তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় স্তরে সুদূরপ্রসারী হতে পারে বলে মনে করছেন দিল্লির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ-এর রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ আদিত্য নিগম।
বেনারনিউজকে তিনি বলেন, “অনেকেই মনে করছেন যে এটাই বিজেপির শেষের শুরু, এবং এর প্রভাব পড়বে ২০২২-এর উত্তর প্রদেশ নির্বাচনেও।”
ভারতের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান উত্তর প্রদেশের। বর্তমানে সেখানে রয়েছে বিজেপি সরকার। তবে নিজেদের সর্বভারতীয় দল হিসেবে আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে বাংলায় জেতার জন্য মরিয়া ছিল বিজেপি।
মমতার বিজেপি-বিরোধী অবস্থান ও ধর্মনিরপেক্ষ তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রচেষ্টার ফলে তাঁকে প্রধান শত্রু মনে করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল।
“গোটা দেশে আরএসএস- বিজেপি যে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন শুরু করেছিল সেটা বাংলার ভোটে শোচনীয়ভাবে হেরে দারুণ ধাক্কা খাবে। গতি পাবে কৃষক সহ বিভিন্ন ধরনের গণ আন্দোলন,” তৃণমূলের জয় নিশ্চিত হওয়ার পর এক বিবৃতিতে জানান ‘নো ভোট টু বিজেপি’ অভিযানের মুখপাত্র তন্ময় ঘোষ।
নির্বাচনের আগে যেসব তৃণমূল নেতা গেরুয়া শিবিরে যোগ দেন, বিজেপি-র বিপুল পরাজয়ের পিছনে তাঁদেরও ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক তথা রাজনীতি বিশেষজ্ঞ শুভাশিস মৈত্র।
তিনি বেনারকে বলেন, “বিজেপির রাজ্য জয়ের হাবভাবকে ভালো চোখে দেখেনি আমজনতা। তাছাড়া প্রায় রোজ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্তরের কোনো না কোনো বড়ো নেতা প্রচারে আসছেন, হেলিকপ্টারে ঘুরছেন, পাঁচতারা হোটেলে থাকছেন, সেটাও দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছিল।”
“ফলে বিজেপি যে আদতে বহিরাগতদের পার্টি, মমতার এই দাবির পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে,” বলেন শুভাশিস মৈত্র।
তাঁর মতে, ধর্মীয় মেরুকরণ, তৃণমূলের আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, ইত্যাদি ইস্যু তুলে জনমতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি বিজেপি। “বরং কিছু আপাত দুর্নীতিপরায়ণ তৃণমূল নেতার বিজেপিতে যোগদানের ফলে জনতার মনে ধারণা জন্মায় যে, বিজেপি আসলে বিশ্বাসঘাতকদের দল।”
বাংলায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে শাসনে থাকা বামফ্রন্টকে হারিয়ে ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস। এরপর দ্বিতীয়বার ২০১৬ ও চলতি বছরে তৃতীয়বারের মতো রাজ্যে ক্ষমতা অব্যাহত রাখল তৃণমূল কংগ্রেস।
পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত হয় আট দফার এই নির্বাচন। গত ২৭ মার্চ নির্বাচন শুরুর মুখে যেখানে রাজ্যে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ৮১২, ২৯ এপ্রিল অষ্টম দফার শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৪০৩। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার দিন ২ মে তা বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ৫১৫।
করোনাভাইরাসে রাজ্যে এখন পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ৬৩১ বলে জানাচ্ছে রাজ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর।
ভারতে ১ মে নতুন করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ৯২ হাজার ৬০৩, মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৭৩ বলে জানাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
ভারতে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি, মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ১৬ হাজারের বেশি।