কলকাতায় এইচআইভি পজিটিভ ১০ তরুণ-তরুণীর কফি শপ
2018.07.20
কলকাতা
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বুকে এইচআইভি পজিটিভ ১০ তরুণ–তরুণীর স্বপ্নযাত্রা বাস্তবে রূপ পেয়েছে। এইচআইভি ও এইডস নিয়ে সমস্ত ট্যাবুকে দূরে সরিয়ে এদের পরিচালিত ভারতের প্রথম কফি শপে ভিড় করছেন সাধারন মানুষ থেকে সেলিব্রিটিরা পর্যন্ত।
“সহানুভূতি নয়, জীবন সংগ্রামে পাশে থাকার অঙ্গীকার নিয়েই সোস্যাল মিডিয়ায় লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যেই এই উদ্যোগকে সমর্থন দিয়েছেন,” বেনারকে বলেন উদ্যোক্তা ‘অফার’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা কল্লোল ঘোষ।
তিনি বলেন, “এই উদ্যোগ এইচআইভি পজিটিভ কমিউনিটির মধ্যেও বিপুল সাড়া ফেলেছে। কয়েকদিনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এইচআইভি আক্রান্তরা এ ধরনের কাফে খোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।”
গত ১৪ জুলাই দক্ষিন কলকাতার ৫২৪-এ যোধপুর পার্কের একটি গ্যারেজের ১০ ফুট বাই ১২ ফুট ঘরে যাত্রা শুরু হয় কাফে পজিটিভের।
এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে কলকাতার বুকে এক চিলতে জায়গা খুঁজে পেতে গত ৬ মাস ধরে উদ্যোক্তারা বারবার প্রত্যাখ্যাত হন। মীরা, সুজাতা, শাশ্বত (ছদ্মনাম) এবং এইচআইভি পজিটিভ অন্যদের কাফে খোলার জন্য জায়গা দিতে রাজি হন নি আধুনিক মনস্ক কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ।
কাফেতে কফির পাত্র এগিয়ে দিতে দিতে মীরা বেনারকে বলেন, “মুখের উপর সকলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। এক সময় তো ভেবেছিলাম, স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না।”
“তবে ৫২৪-এ যোধপুর পার্কের বাসিন্দা ইন্দ্রজ্যোতি দাশগুপ্ত এই তরুণ তরুণীদের জীবন সংগ্রামের কথা ভেবে তার নিজের গাড়িকে অন্যত্র সরিয়ে নিজের গ্যারেজে নতুন স্বপ্নের পথচলায় শরিক হয়েছেন,” বলেন কল্লোল ঘোষ।
ক্যাফে পজিটিভে বন্ধুকে নিয়ে কফি খেতে আসা কলকাতার একটি স্কুলের শিক্ষিকা সুপ্রিয়া রায় বেনারকে বলেন, “এখানকার সবাই এইচআইভি আক্রান্ত এটা জেনেই আমরা এখানে এসেছি। আমাদের মত আরও মানুষ সমস্ত দ্বিধা ও স্টিগমাকে সরিয়ে রেখে এদের পাশে থাকার বার্তা দেবেন বলে আমরা আশা রাখি।”
“এইচআইভি পজিটিভ দশ জনই এই ক্যাফে পজিটিভের মালিক। ১০ জনের মধ্যে ৬ জন তরুণী, বাকী চারজন তরুণ। এদের কেউ পড়াশোনা করছে, কেউ বিভিন্ন কোর্সের তালিম নিচ্ছে। এই উদ্যোগে সক্রিয়ভাবে অংশ রয়েছে সমাজের নানা স্তরের ১৬০০ মানুষের”, বলেন কল্লোল ঘোষ।
তিনি বলেন, “কাফের এসি, কফি মেশিন, মাইক্রোওভেন, ফ্রিজ এই সব জিনিষই উপহার হিসেবে পাওয়া।”
স্বপ্নের বুনন
“জন্মের পর থেকেই ঘাতকরোগে আক্রান্ত ও পরিজন পরিত্যক্ত এদের ঠিকানা হয়েছিল ‘অফার’ পরিচালিত ‘আনন্দঘর’ হোম। চিকিৎসার পাশাপাশি লেখাপড়া শিখে এখন এরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে এদের দশজনই এখন পেশাদার শেফের যোগ্যতা অর্জন করেছে,” বলেন হোমের কর্তা ব্যক্তি কল্লোল ঘোষ।
তিনি বলেন, “প্রাপ্ত বয়স্ক এইচআইভি আক্রান্ত মানুষগুলিকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সাহস করে বেরিয়ে আসার দরজা খুলে দিতে না পারলে এরা আড়ালেই থেকে যাবে।”
তাঁর মতে, “আগামী দিনে কলকাতার অন্যত্র এইচআইভি পজিটিভদের দিয়ে আরও ক্যাফেটারিয়া খোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে এটাকে ব্যবসা হিসেবে দেখা নয়, বরং এর ভুমিকা হবে ক্যাটালিস্টের।”
ভুল ধারণা দূর হয় নি
“এইচআইভি/এইডস নিয়ে ভুল ধারণা দূর করতে প্রচারের কিছু সুফল পাওযা গেলেও সমাজে আক্রান্ত মানুষগুলির গ্রহণ যোগ্যতা বাড়াতে এবং এদের সম্পর্কে মানুষের স্টিগমা দূর করতে এইচআইভি পজিটিভি মানুষগুলির কাফে খোলার উদ্যোগকে স্বাগত জানাতেই হয়,” বেনারকে বলেন বেঙ্গল নেটওয়ার্ক অব পিপলস লিভিং উইথ এইচআইভি/এইডস (বিএনপিএল) এর ভাইস চেয়ারম্যান তড়িৎ চক্রবর্তী।
এইডস নিয়ে কাজ করেন এমন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বর্তমানে প্রায় আড়াই লক্ষের মত এইচআইভি আক্রান্ত মানুষ রয়েছে। আর প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করে এইচআইভি পজিটিভ নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গেও সব মিলয়ে প্রায় ১০ হাজার এইচআইভি পজিটিভ মানুষ রয়েছেন।
তবে চিকিৎসক ও লেখক ডা. অমিতাভ ভট্টাচার্য বেনারকে বলেন, “মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু অনেক প্রচার সত্ত্বেও এইচআইভি/ এইডস সম্পর্কে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের ভুল ধারণা এখনও দূর করা সম্ভব হয় নি।”
“শতহস্ত দূরে থাকার মানসিকতা এখনও সাধারন মানুষের মধ্যে প্রবল। আমি এই বিষয়ে নাটক লিখে ও তা নিয়মিত মঞ্চস্থ করেও তেমনভাবে সফল হতে পারিনি,” বলেন তিনি।
ডা. ভট্টাচার্যের মতে, “সমাজে ব্রাত্য করে রাখার ফলে এইচআইভি পজিটিভ মানুষগুলি আস্থা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। তবে এদের উত্তরণের জন্য ক্যাফে পজিটিভির মত উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।”
অবশ্য ক্যাফেতে দাঁড়িয়ে ২১ বছরের শাশ্বত স্পষ্ট করেই বেনারকে বলেন, “আমরা অনুকম্পা চাই না। আমাদের সমাজে ব্রাত্য করে রাখার প্রবণতা দূর হোক এটাই চাই।”