জাতীয় নির্বাচন: সাধারণ মানুষের অসাধারণ কথা
2023.12.15
ঢাকা
![জাতীয় নির্বাচন: সাধারণ মানুষের অসাধারণ কথা জাতীয় নির্বাচন: সাধারণ মানুষের অসাধারণ কথা](https://bendev.benarnews.org/bengali/news/whatpeoplesaying-12152023161143.html/@@images/74bd1dd6-3a8f-4781-8baa-6c7dee3be33f.jpeg)
“বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে বিয়ে বাড়ির মতো আনন্দের উৎসব, ঢাকা থেকে যা ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রত্যন্ত এলাকার পাড়া-মহল্লায়। কোথাও মানুষের মধ্যে সেই আনন্দ আছে বলে মনে হয় না,” বললেন রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় একটি বাণিজ্যিক ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী নান্টু হাওলাদার রানা (৫৫)।
শরীয়তপুরের ডামুড্যা এলাকার এই বাসিন্দা বেনারকে বলেন, একা একা কী আর ভোট হয়? সবাইকে নিয়েই ভোট করতে হয়।
তার জিজ্ঞাসা- “এটা তো আওয়ামী লীগের নৌকার সাথে স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগের প্রতিযোগিতা; মাঠে আর তেমন কেউ নেই। তাহলে এটা কেমন নির্বাচন?”
নান্টু হাওলাদারের মতো বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের পরিবেশ ঘিরে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। আসন্ন এই নির্বাচনের ওপর শুক্রবার বেনারনিউজের পক্ষ থেকে মোট ৩৭ জনের মতামত চাওয়া হয়। তাদের মধ্যে ১৪ জন বক্তব্য দিয়েছেন। পরিচয় প্রকাশ করে মন্তব্য করতে চাননি বাকিরা, কেউ কেউ মন্তব্য করলেও অজানা আশংকায় ছবি দিতে চাননি।
তবে বক্তব্য দেওয়া সবাই এক বাক্যে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তাদের প্রায় সবারই আশংকা, একতরফা নির্বাচন দেশের জন্য অমঙ্গলজনক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
“আওয়ামী লীগ তো সহজে ক্ষমতায় থাকার বুদ্ধি পাইছে। এখন কেন তারা বিরোধী দলকে নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন করতে যাবে,” ঢাকার বেসরকারি একটি কোম্পানীর কর্মকর্তা অলক কুমার সরকার বেনারকে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, “আমি এবং আমার পরিবার সবাই মোটামুটি নৌকায় ভোট দেই। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের আর ভোটারদের লাগে না। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের অভিজ্ঞতায় ভোটার ছাড়াই আরেকটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী উম্মে সুহালা বেনারকে বলেন, “বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও আমরা দেখেছি তারা একতরফা নির্বাচন করতে চেয়েছে এবং তখন আওয়ামী লীগ তা বন্ধ করার চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর ক্ষমতায়, সব জায়গায় নিজেদের লোক বসিয়েছে। সুতরাং, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আসলেও নির্বাচন কতটুকু নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।”
রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল বিভাগের ছাত্র সায়েম আল আনান (২৬) বেনারকে বলেন, “গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হলো কার্যকর বিরোধীদলের উপস্থিতি। বিএনপি বড় বিরোধী দল হলেও তাদের নেতৃত্বের বড় সংকট আছে। সরকারও সেই সুযোগ নিচ্ছে।”
“আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু নেতা যারা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করেন তাঁরা আমাদের শোনালেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে কে, কতগুলো ব্যালট পেপারে সিল দিয়েছেন। এসব বক্তব্য আমাদের ব্যথিত ও নির্বাচন নিয়ে অনাগ্রহ তৈরি করে।”
ঢাকার রিক্সাচালক আমজাদ আলী
শেরপুর জেলার নালিতা উপজেলার বাসিন্দা ও ঢাকা শহরের রিক্সাচালক আমজাদ আলী (৭০) বলেন, “ভোটে পাবলিকের আর কদর নাই। ভোটে যা হওয়ার তাই হইবো। আমরার কিছু করার নাই।”
“কিন্তু বিএনপি যেভাবে গাড়ি পোড়াইতাছে, হেইডাও ঠিক না। ধরেন আপনার একটা গাড়ি আছে। গাড়িডা পোড়াইলো তো আপনি পথে বসলেন। সরকারের তো কিছুই হইব না।”
মতিঝিল এলাকায় ফুটপাতে পুরানো কাপড়ের ব্যবসায়ী ও চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা মো. নুরুল আমিন বলেন, “একা একা নির্বাচন করলে তো সেটা নির্বাচন বলা যায় না। আওয়ামী লীগের উচিত বিএনপি যাতে নির্বাচনে আসে সেই ব্যবস্থা করা। অবশ্য বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে তো তাদের জোর করে ভোটে আনতেও পারবে না সরকার।”
ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সোমা তার পুরোনাম বলতে চাননি।
“যদি আমার নাম-পরিচয় ও ছবি প্রকাশিত হয় তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতির দায় তো আমাকেই নিতে হবে। আমাকে দেশদ্রোহী বানানো হতে পারে,” বলেন ওই শিক্ষিকা।
তিনি বলেন, “আমি নির্বাচন নিয়ে কিছু চিন্তা করি না। ভোট আমার কাছে কোন বিষয় না। ২০১৮ সালে প্রথম ভোটার হলাম। কিন্তু ভোট দিতে গিয়ে দেখলাম কে যেন আমার ভোট দিয়ে দিয়েছে। তাই আমি ভোট কী জিনিস তা বোঝার সুযোগ পাইনি।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করা শিক্ষার্থী তমা (পুরো নাম প্রকাশ করতে চান না) চাকরি খুঁজছেন। তিনি বলেন, “আমার কাছে নির্বাচন, রাজনীতি কিছুই না। আমাকে চাকরি পেতে হবে। সেই সুযোগ দেশে নেই বললেই চলে।”
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকাট্রনিক্স বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আহনাফ তানজিদ মনে করেন, “দু্ই রাজনৈতিক দলের উচিত আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করা যাতে রাস্তার সহিংসতা বন্ধ হয়। আলোচনা করলে সমাধান বের হবেই।”
তার মতে, “হরতাল-অবরোধ একটি ভুল পদক্ষেপ। ১৯৭০-৭১ সালের হরতাল-অবরোধ এবং এখনকার হরতাল-অবরোধ এক নয়। সেই সময় সব মানুষ দেশের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য একজোট ছিল। কিন্তু এখনকার হরতাল-অবরোধে মানুষের কোনও সমর্থন নেই।”
রাজধানীর বাংলামটর এলাকায় একটি বাড়িতে কেয়ারটেকার হিসেবে চাকরি করেন নিজাম খাঁ (৫০)। তার মতে, এটা নির্বাচন বলা হলেও ঠিক নির্বাচন না। এ নিয়ে তার কোনো ভাবনাও নেই।
সামনে যে নির্বাচন আসছে সেটি আসলে জনগণের নির্বাচন নয়, সরকারের নির্বাচন বলে মনে করেন ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী জুবায়ের হোসেন জুমান। তিনি বলেন, এই নির্বাচন হলে হয়তো সরকার জিতে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে চরম দুর্দশা ভোগ করতে হবে।
তার মতে, নির্বাচন বর্জন করা দলগুলো নির্বাচন ঠেকানোর জন্য মরিয়া হয়ে আছে, আর সরকার উন্মাদ হয়ে আছে নির্বাচন করার জন্য। দুই পক্ষের এই বিপরীতমুখী অবস্থান বাংলাদেশকে অনিবার্য বিপদের দিকে নিয়ে যাবে।
তরুণ শিক্ষার্থী সায়েম আল আনান
প্রকৌশলী রায়হান তানভীর বলেন, নির্বাচনের প্রচলিত ব্যবস্থাটাই ক্রুটিপূর্ণ। এমনিতেও প্রতিনিধি নির্বাচন যথাযথ হয় না। সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচনকে প্রতিনিধিত্বমূলক বলা যাবে না। আর এখনকার অবস্থা তো আরও নাজুক।
সাতক্ষীরা থেকে মাছ এনে ঢাকায় বিক্রি করেন মাছ ব্যবসায়ী শেখ আলতাফুজ্জামান (৫৫)। তিনি বলেন, “এই নির্বাচন আয়োজন না করে বরং বলে দেওয়া উচিত ছিল যে, প্রধানমন্ত্রী দেশের অনেক উন্নয়ন করেছেন। যতদিন তিনি জীবিত থাকবেন ততদিন কারো ক্ষমতায় আসার দরকার নেই।”
সরকার একতরফাভাবে ভাগ-বাটোয়ারার নির্বাচন করছে বলে মত দিলেন তরুণ ভোটার ও ঢাকা স্টেট কলেজের শিক্ষার্থী মোসলেহ উদ্দিন বিজয়। তিনি বলেন, চাই অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচন, যেখানে সবাই ভোট দিতে পারবে।
“কিন্তু সরকার জেনেবুঝে বাংলাদেশের মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এটাকে নির্বাচন না বলে সিলেকশন বলা যায়, যেখানে সরকার ক্ষমতা নবায়ন করছে মাত্র। এমন একটি নির্বাচনের পর সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলবে কিনা-সেটিও বড় প্রশ্ন,” বলেন বিজয়।