নব্য জেএমবি নারীদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করছে
2016.12.27
আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের মতাদর্শভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি বাংলাদেশে নারীদের সাংগঠনিক কাজে যুক্ত করছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নারীদের যুক্ত করার ঘটনাগুলো ব্যতিক্রমধর্মী, একই সঙ্গে ভীতিকরও বটে।
গতকাল মঙ্গলবার সিটিটিসি বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “জঙ্গিদের প্রবণতা হলো নারীরা তাদের সহযোগিতা ও সেবা দেবে এবং শিশু–কিশোরদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করবে।”
গত শুক্রবার রাজধানীর পূর্ব আশকোনায় ‘সূর্যভিলা’ নামে একটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানায় ১৬ ঘন্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযান চালানোর পর গতকালই পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে নারী জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে মন্তব্য করল।
কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গিদের মৃত্যুর পর তাদের স্ত্রীদের সাংগঠনিকভাবে আবার কোনো এক জঙ্গির সঙ্গে বিয়ে হয়। ফলে তাঁরা আর সংগঠন থেকে বের হতে পারে না।
ওই বাড়িটিতে জঙ্গি অভিযানে নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা ও তাঁর ১৪ মাস বয়সী শিশু, আজিমপুর অভিযানে আত্মঘাতী জঙ্গি তানভির কাদেরীর ছেলে আফিফ কাদেরী, নব্য জেএমবির অন্যতম সংগঠক মঈনুল ওরফে মুসার স্ত্রী তৃষা মণি ও তাঁর পাঁচ মাস বয়সী শিশু এবং জেএমবির সদস্য সুমন ওরফে সাগরের স্ত্রী শাকিরা ও তাঁর সাত বছরের মেয়ে বসবাস করছিল।
সিটিটিসির কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বেনারকে বলেন, “এ বাড়িটি থেকেই আমরা র্সবোচ্চ সংখ্যক ২৩টি বোমা উদ্ধার করেছি। শিশুদের নিয়ে এরা কী করে এমন একটি বিপজ্জনক জায়গায় অবস্থান করছিল, সেটা একটা বিস্ময়।”
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া অপর কমকর্তা মো. ছানোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “শিশুকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে কোনো মায়ের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা এই প্রথম।”
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে ওই কর্মকর্তা বলেন, “নারী ও শিশু আছে জেনে আমরা শুরু থেকেই তাদের আত্মসমর্পণের অনুরোধ জানাচ্ছিলাম। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর ওই নারী সন্তানকে সঙ্গে করে বেরিয়ে আসতে থাকে। আমরা তাকে মাথার ওপর দু হাত তুলতে বলি। কিন্তু সে শিশুটিকে এগিয়ে দেয়।”
ছানোয়ার আরও বলেন, “আমরা যখন শিশুটিকে নিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই সে সুইসাইডাল ভেস্টটির বিস্ফোরণ ঘটায়।”
কেন জড়াচ্ছেন নারীরা
মনিরুল ইসলাম বলেন, নারীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে। স্বামীরা তাঁদের বাধ্য করছে। ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, অনেক নারীর স্বামী নিহত হয়েছে, অনেকে আবার জেলে। কেউ কেউ হতাশা থেকেও বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
‘সূর্যভিলা’ থেকে গ্রেপ্তার নারীদের গতকাল প্রথম দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জেবুন্নাহার শিলা তাদের বলেছে, যে পথে সে যাত্রা শুরু করেছে সেখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা নেই। তাঁর মতে, পরিবার ও সমাজ-কেউই তাকে আর গ্রহণ করবে না।
অন্যদিকে তৃষা মণি বেনারকে বলেন, শুরু থেকেই সে মঈনুল ওরফে মুসার জঙ্গি কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ছিল। অভিযানের শুরু থেকেই সে পুলিশকে সহযোগিতা করেছে। এখনও সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক শাহেদুল আনাম খান বলেন, “আইএস নারীদের ব্যাপারে যে নীতি অনুসরণ করে থাকে, তারাও (নব্য জেএমবি) সেটা অনুসরণ করছে। আইএস নারীদের, বিশেষ করে খ্রিস্টান, ইয়াজিদি, শিয়া ও অন্য ধর্ম বিশ্বাসের নারীদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করছে, ইসলামের আর্দশের সঙ্গে যা একেবারেই যায় না।”
তিন পরিবারই দুষছে জামাইদের
জেবুন্নাহার শিলার মা জোহরা খাতুন তাঁর মেয়ের এই পরিণতির জন্য মেয়ের স্বামী মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামকে দায়ী করেছেন। অভিযানে নিহত আফিফ কাদেরীর মায়ের পক্ষের স্বজনের অভিযোগ করেছেন, তানভীর কাদেরির বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে তৃষা মণির বাবা আবদুস সামাদ বলেন, মঈনুল ওরফে মুসা বিদেশে যাওয়ার কথা বলে মেয়েকে নিয়ে গিয়ে বিভ্রান্ত করেছে।
জোহরা খাতুন ছাড়া কেউই তাঁদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া মেয়েদের দেখতে ডিবি কার্যালয় বা কারাগারে যাননি। তাঁরা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। হেনস্থা হওয়ার ভয়ে আর মেয়েদের ব্যাপারে কথা বলছেন না।
অনলাইনে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে নারীরা
স্বামীর সাহর্চযে জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষিত নারীরা ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে ও পরস্পর যোগাযোগ করে আইএসের মতাদর্শ পালন করছে ও ছড়াচ্ছে।
গত ১৫ থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানী ও এর উপকণ্ঠে অভিযান চালিয়ে পাঁচ নারী জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সন্ত্রাস দমন আইনে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গতকাল ওই মামলার অভিযোগপত্র আদালত গ্রহণ করেছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. সামছুল হক বেনারকে বলেন, “ওই নারীরা সংগঠনের দাওয়াতী পর্যায়ের সদস্য ছিলেন। গ্রেপ্তার না হলে নাশকতা ঘটানোর আশঙ্কা ছিল।”
সামছুল হক বলেন, র্যাবের হাতে ধরা পড়া ওই নারী জঙ্গি দলের প্রধান ছিলেন আকলিমা বেগম। তিনি মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
তিনি জানান, গাজীপুরের খাইলকুরের একটি মসজিদের সামনে জনৈক বইয়ের দোকানদার তাঁকে জেএমবি নেতা মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে পরিচয় করায়। মাহমুদুল হাসান ‘তাজরিয়ান আনহার’ পরিচয়ে ফেসবুকে আইএসের মতাদর্শ প্রচার করত। অনলাইনে আকলিমার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। এই আকলিমাই পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ইসতিসনা আখতারসহ পাঁচজনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়। ইসতিসনা বিকাশের মাধ্যমে সাংগঠনিক কাজে খরচের জন্য টাকাও দেয় মাহমুদুল হাসানকে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক এলাহী চৌধুরী বেনারকে বলেন, স্বামীরা যেমন স্ত্রীদের উদ্বুদ্ধ করছে, তেমনি স্ত্রীরাও স্বামীদের উদ্বুদ্ধ করছে। এমনকি শিক্ষার্থীরাও একে অপরকে উদ্বুদ্ধ করছে এবং নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেন, গায়ক তাহমিদ শাফিকে উদ্বুদ্ধ করেছে তাঁর স্ত্রী সায়েমা খান।
“তবে যে, যাকেই উদ্বুদ্ধ করুক না কেন, এটা সত্য যে নারীরা জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই নারী ও শিশুদের সাধারণত সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা হয়। সেদিক থেকে এই পরিস্থিতি নতুন ও ভীতিকর।”